অন্ধকার রাতে হঠাৎ তীব্র ব্যথা নিয়ে এক ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তার চারপাশে আতঙ্কিত মানুষের ভিড়। কেউ ভাবছেন, তিনি আর বাঁচবেন না। কেউবা দ্রুত ডাক্তার ডাকতে ছুটলেন। এ দৃশ্য হয়তো আপনি সিনেমায় দেখেছেন বা বাস্তবে শুনেছেন। হৃদরোগ, বিশেষত হার্ট অ্যাটাক, এমনই এক ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি যা জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে মানুষকে ফেলে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায়? দ্রুত কি কি পদক্ষেপ নিলে মৃত্যু ঝুঁকি কমানো যায়?
হৃদপিণ্ড আমাদের শরীরের এক অমূল্য অঙ্গ। এটি প্রতি মিনিটে প্রায় ৭০ বার স্পন্দিত হয়ে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে দেয়। কিন্তু যখন হৃদপিণ্ডের রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তখনই ঘটে হার্ট অ্যাটাক। এই আঘাত কতটা মারাত্মক হবে, তা নির্ভর করে সময়মতো চিকিৎসা এবং ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা ওপর।
হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে সাধারণ ধারণার বাইরেও আছে কিছু বিস্ময়কর তথ্য। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা যান প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ। কিন্তু এর বিপরীতে অনেকেই সঠিক চিকিৎসায় নতুন জীবন ফিরে পান। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, এর লক্ষণ কী, বাঁচার সম্ভাবনা কতটুকু এবং কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
মেডিকেলের ভাষায় হার্ট অ্যাটাক কি?
হার্ট অ্যাটাক, যা মেডিকেলের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction) নামে পরিচিত, হলো একটি গুরুতর চিকিৎসাজনিত অবস্থা। এটি ঘটে যখন হৃদযন্ত্রে রক্ত সঞ্চালনের পথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। সাধারণত, হার্টের ধমনীতে চর্বি, কোলেস্টেরল, অথবা অন্যান্য পদার্থ জমা হয়ে প্লাক তৈরি করে। এই প্লাক যদি ফেটে যায় বা সম্পূর্ণরূপে ধমনী বন্ধ করে দেয়, তখন হৃদযন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হলে হার্টের পেশির কোষে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, যার ফলে সেই অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মরে যেতে পারে। এর ফলে বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা, বাম হাতে বা কাঁধে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বমি ভাব, এবং অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ডায়াবেটিস, এবং উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা উল্লেখযোগ্য। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, অক্সিজেন সরবরাহ, এবং রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য মেডিকেশন বা এনজিওপ্লাস্টির মতো পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। জীবনধারায় পরিবর্তন, যেমন সুষম খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং ধূমপান পরিহার করা, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সহায়ক।
হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে কয়েকটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা
হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে অনেক প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা মানুষকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়। প্রথমত, অনেকে মনে করেন হার্ট অ্যাটাক শুধুমাত্র বয়স্কদের হয়, তবে বাস্তবে এটি যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে, এমনকি তরুণদেরও। দ্বিতীয়ত, “যদি বুকে তীব্র ব্যথা না হয়, তবে হার্ট অ্যাটাক হয়নি”—এই ধারণাও ভুল। অনেক ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, বা বমি ভাবের মতোও হতে পারে। তৃতীয়ত, কিছু মানুষ মনে করেন, শুধুমাত্র স্থূলকায় বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের হার্ট অ্যাটাক হয়, কিন্তু সাধারণ স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষেরও হতে পারে। আরও একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, একবার হার্ট অ্যাটাক থেকে সেরে উঠলে আর ঝুঁকি থাকে না। বাস্তবে, যারা একবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন, তাদের পুনরায় ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব ভুল ধারণা দূর করতে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতা, যা মানুষকে সময়মতো চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করবে এবং জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে।
হার্ট অ্যাটাক কেবল বয়স্কদের হয়
হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো এটি কেবল বয়স্কদের রোগ। যদিও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে, তবুও এটি শুধু বয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে তরুণ বয়সেই অনেকে এই সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক চাপ, স্থূলতা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, এবং ধূমপানের মতো বিষয় তরুণদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ থেকে ৪০ বছরের অনেক তরুণও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাছাড়া, কম বয়সে সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানো বা সমস্যা উপেক্ষা করার প্রবণতাও এই ঝুঁকি বাড়ায়।
এর পাশাপাশি জেনেটিক কারণও একটি বড় ভূমিকা পালন করে। পরিবারের কারো যদি হার্টের রোগ থাকে, তবে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এমনকি নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার পরেও জেনেটিক প্রভাবের কারণে তরুণ বয়সে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাই হার্ট অ্যাটাক শুধুমাত্র বয়স্কদের রোগ এই ধারণা পুরোপুরি ভুল। তরুণদের ক্ষেত্রেও এই ঝুঁকি এড়াতে সচেতন হওয়া জরুরি।
হার্ট অ্যাটাক সবসময় তীব্র ব্যথার মাধ্যমে হয়
একটি সাধারণ ভ্রান্ত ধারণা হলো, হার্ট অ্যাটাক মানেই তীব্র বুকের ব্যথা। বাস্তবে, এটি সবসময় সত্য নয়। অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো অতিরিক্ত তীব্র না-ও হতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে বুকের মাঝখানে চাপ অনুভব, বমি ভাব, মাথা ঘোরা, চোয়াল, পিঠ, বা হাতের ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলো সাধারণত তীব্র নয় বলে রোগীরা এগুলোকে অবহেলা করেন। এমনকি কিছুক্ষেত্রে “নীরব হার্ট অ্যাটাক” ঘটে, যেখানে তেমন কোনো বিশেষ উপসর্গই দেখা যায় না।
এই ধরনের মৃদু লক্ষণ অবহেলা করলে হৃদরোগের প্রকোপ বাড়তে পারে এবং তা জীবনহানির কারণ হতে পারে। তাই বুক ব্যথা বা চাপ ছাড়াও যদি কেউ শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক ঘাম, বা অন্যান্য অস্বস্তি অনুভব করেন, তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করাই জীবন রক্ষার মূলমন্ত্র।
শুধুমাত্র ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাক হয়
ধূমপান হার্ট অ্যাটাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলেও এটি একমাত্র কারণ নয়। অনেকের মনে ধারণা, যদি কেউ ধূমপান না করেন, তবে তাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি নেই। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ধূমপান ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, এবং শরীরচর্চার অভাবও সমানভাবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া অতিরিক্ত ফাস্টফুড গ্রহণ, রাতে ঘুমের সমস্যা, এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে না থাকাও এই সমস্যার প্রধান কারণ হতে পারে।
এছাড়া, জেনেটিক কারণও এখানে ভূমিকা রাখে। এমনকি যদি কেউ কখনো ধূমপান না করে থাকেন, তবুও পারিবারিক ইতিহাস বা জিনগত প্রভাবের কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। সুতরাং, কেবল ধূমপান পরিহার করলেই ঝুঁকি মুক্ত হওয়া যায় না। জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টরগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক।
হার্ট অ্যাটাকের পরে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়
হার্ট অ্যাটাকের পর অনেকেই মনে করেন, তাদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ থেমে যাবে। এই ধারণা সঠিক নয়। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীরা আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ, এবং সঠিক ডায়েট মেনে চলা হার্টের কার্যক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে। অনেকেই হার্ট অ্যাটাকের পর মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার সাহস হারিয়ে ফেলেন। তবে সঠিক চিকিৎসা এবং ইতিবাচক মনোভাব জীবনের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়ক।
তাছাড়া, হার্ট অ্যাটাকের পর জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। যেমন ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করা, সুষম খাদ্যগ্রহণ, এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা। কিছু রোগী নিয়মিত কার্ডিয়াক রিহ্যাব প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। হার্ট অ্যাটাক কোনো জীবনের শেষ নয় বরং একটি নতুন শুরুর সুযোগ। সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে রোগীরা সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারেন।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ অসম্ভব
অনেকের ধারণা, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। যদিও জেনেটিক কারণ বা বয়সের মতো কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধযোগ্য। জীবনধারায় পরিবর্তন আনাই এর মূল চাবিকাঠি। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, যেমন কম চর্বিযুক্ত খাবার, প্রচুর শাকসবজি এবং ফাইবার খাওয়া হার্ট সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, মানসিক চাপ কমানো, এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। ধূমপান বা মদ্যপানের মতো অভ্যাস পরিহার করাও অত্যন্ত জরুরি। তবে এর জন্য সঠিক পরামর্শ এবং সচেতনতা প্রয়োজন। হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ অসম্ভব নয়, বরং সচেতন জীবনযাপন এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এটি সহজেই এড়ানো সম্ভব।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ সাধারণত বুকে তীব্র ব্যথা দিয়ে শুরু হয়, যা বুকের মাঝখান থেকে বাম হাত, ঘাড় বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি চাপা, পোড়ার মতো বা ভারি বস্তু চাপ দেওয়ার অনুভূতি তৈরি করে। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অতিরিক্ত ঘাম, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, এবং তীব্র ক্লান্তি দেখা যেতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে, যেমন পিঠ বা পেটের ব্যথা এবং অস্বাভাবিক ক্লান্তি। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত “সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক”-এ, উপসর্গগুলো খুবই মৃদু বা প্রায় অনুপস্থিত থাকতে পারে। যে কোনো সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

শারীরিক পরিবর্তন: তীব্র ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট
হার্ট অ্যাটাক হলে সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ হলো তীব্র ব্যথা, যা সাধারণত বুকের মাঝখানে অনুভূত হয়। এই ব্যথা বুক থেকে চোয়াল, পিঠ, কাঁধ, বা বাম হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় এটি এত তীব্র হয় যে রোগী শারীরিকভাবে স্থির থাকতে পারেন না। এই ব্যথা সাধারণত কয়েক মিনিট ধরে থাকে এবং বিশ্রাম নিলেও কমে না। এটি হার্টে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়, যা তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। তাছাড়া, এই ব্যথা অনেক সময় চাপ বা বুকের ভারি অনুভূতির মতোও হতে পারে, যা রোগীরা সহজে বুঝতে পারেন না এবং অবহেলা করতে পারেন।
শ্বাসকষ্টও হার্ট অ্যাটাকের আরেকটি বড় লক্ষণ। হার্ট ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে ফুসফুসেও এর প্রভাব পড়ে, যার ফলে রোগী স্বাভাবিক শ্বাস নিতে অসুবিধা অনুভব করেন। শ্বাসকষ্ট সাধারণত ব্যথার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দেয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ব্যথার আগেও হতে পারে। রোগীর মনে হয়, যেন ফুসফুসে যথেষ্ট অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না। শ্বাসকষ্টের কারণে রোগীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল বোধ করে। এই লক্ষণ অবহেলা করলে দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে।
অন্যান্য উপসর্গ: ক্লান্তি, ঘাম, বমি ভাব
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে ক্লান্তি বা দুর্বলতার অনুভূতি সাধারণ একটি উপসর্গ। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। রোগী হঠাৎ করেই দৈনন্দিন কাজ করতে অসমর্থ হন এবং শরীরে কোনো শক্তি পান না। এটি হার্টে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার একটি প্রাথমিক সংকেত হতে পারে। তবে অনেকেই এই ক্লান্তি বা দুর্বলতাকে সাধারণ অবসাদ মনে করেন এবং চিকিৎসকের কাছে যান না। এটি বিশেষত ভয়ঙ্কর হতে পারে, কারণ অন্যান্য উপসর্গের আগেই এটি ঘটতে পারে।
অতিরিক্ত ঘাম এবং বমি ভাবও হার্ট অ্যাটাকের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। রোগীর শরীর ঠান্ডা ঘামে ভিজে যেতে পারে, যা অনেক সময় উদ্বেগ বা গরম আবহাওয়ার কারণে হয়েছে বলে মনে হয়। বমি ভাব বা পেটে অস্বস্তি অনেক সময় খাবার হজমে সমস্যা বলেও মনে হতে পারে। তবে এই লক্ষণগুলো যদি হঠাৎ করে এবং অন্যান্য লক্ষণের সঙ্গে একত্রে ঘটে, তবে এটি হার্ট অ্যাটাকের সতর্ক সংকেত হতে পারে।
লক্ষণের ভিন্নতা: নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে পার্থক্য
নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের মধ্যে সাধারণত তীব্র বুকের ব্যথা বেশি দেখা যায়। এই ব্যথা বুকের মাঝখানে অনুভূত হয় এবং তা ধীরে ধীরে বাম হাত বা কাঁধে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় এটি চাপের মতো বা ভারি কোনো জিনিস বুকের ওপর রাখার মতো অনুভূত হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট এবং অতিরিক্ত ঘামের লক্ষণও সাধারণত তীব্র হয়।
অন্যদিকে, মহিলাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো তুলনামূলকভাবে ভিন্ন এবং কম স্পষ্ট হতে পারে। মহিলারা বুকের ব্যথার বদলে পিঠ, চোয়াল, বা কাঁধে ব্যথা অনুভব করতে পারেন। তাছাড়া, ক্লান্তি, বমি ভাব, এবং পেটের অস্বস্তি মহিলাদের মধ্যে সাধারণত বেশি দেখা যায়। এই ভিন্নতাগুলো অনেক সময় রোগ নির্ণয়ে জটিলতা তৈরি করে। নারীদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো কম স্পষ্ট হওয়ায় তারা সময়মতো চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করতে পারেন, যা তাদের ঝুঁকি বাড়ায়।
হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায়?
হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হলো না। হার্ট অ্যাটাক মানেই মৃত্যু নয়। এটি একটি গুরুতর শারীরিক অবস্থা, কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হার্ট অ্যাটাক তখনই মারাত্মক হয়ে ওঠে, যখন আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত চিকিৎসা পান না বা হৃদপিণ্ডের ক্ষতি বেশি হয়। “গোল্ডেন আওয়ার” নামে পরিচিত প্রথম এক ঘণ্টা সময়টি জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলে রক্তপ্রবাহ পুনরায় সচল করা সম্ভব, যা ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি হার্ট অ্যাটাকের পর প্রাণ বাঁচানোর সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে।
তবে বেঁচে থাকার জন্য শুধু চিকিৎসা যথেষ্ট নয়; হার্ট অ্যাটাক হলে সেরে ওঠার পর জীবনধারায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ধূমপান পরিহার, সুষম খাদ্য গ্রহণ, এবং নিয়মিত ব্যায়াম হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। পরিসংখ্যান বলছে, সঠিক পদক্ষেপ নিলে হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে ওঠার হার প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তাই সচেতনতা, সময়মতো সাড়া, এবং সুস্থ জীবনধারা বেছে নিয়ে হার্ট অ্যাটাকের ভয়কে জয় করা সম্ভব।
সময়মতো চিকিৎসার ভূমিকা
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসা জীবন রক্ষার প্রধান উপাদান। হার্ট অ্যাটাকের প্রথম এক ঘণ্টাকে “গোল্ডেন আওয়ার” বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া যায় এবং সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, তবে হৃদপিণ্ডের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা যেমন এঞ্জিওপ্লাস্টি, স্টেন্ট বসানো, বা বাইপাস সার্জারি হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ পুনরায় চালু করতে সাহায্য করে। এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের মারাত্মক প্রভাব এড়ানো যায়।
তাছাড়া, জরুরি চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিক ওষুধ এবং লাইফ সাপোর্ট রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না পেলে হার্টের পেশিগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা পরবর্তীতে হৃদরোগ বা কার্ডিয়াক ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হার্ট অ্যাটাকের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়াই একমাত্র সঠিক পথ।
সঠিক জীবনধারায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা
হার্ট অ্যাটাক হলে সঠিক জীবনধারা মেনে চললে দীর্ঘ সময় সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। তাই হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায়? এর উত্তর হলো সঠিক চিকিৎসার পরে রোগীকে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে সুষম খাদ্য গ্রহণ, যেমন কম চর্বিযুক্ত খাবার এবং প্রচুর শাকসবজি খাওয়া, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধূমপান, মদ্যপান পরিহার, এবং নিয়মিত ব্যায়াম হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া মানসিক চাপ কমানো এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাও এই রোগ এড়াতে সাহায্য করে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ওষুধ গ্রহণ করলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। হার্ট অ্যাটাককে জীবনের একটি বিপদ না ভেবে নতুনভাবে শুরু করার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত। রোগীরা সঠিক জীবনধারার মাধ্যমে আবারও স্বাভাবিক এবং কার্যক্ষম জীবনযাপন করতে পারেন।
পরিসংখ্যান: বেঁচে থাকার হার কতটা?
হার্ট অ্যাটাক হলে বেঁচে থাকার হার চিকিৎসার অগ্রগতির সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, যারা সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছান এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী বেঁচে থাকেন। তাহলে বুঝতেই পারছন- হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায় কিনা। তবে সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। উন্নত চিকিৎসা এবং দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে ৫ বছরের মধ্যে বেঁচে থাকার হার ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি হতে পারে।
তবে বেঁচে থাকার হার রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ওপর নির্ভর করে। যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বা ধূমপান করার ইতিহাস থাকলে বেঁচে থাকার হার কিছুটা কমতে পারে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই হার কিছুটা কম, কারণ সেখানে জরুরি চিকিৎসার সহজলভ্যতা কম। সঠিক সচেতনতা এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার ঘটিয়ে বেঁচে থাকার এই হার আরও বাড়ানো সম্ভব।
জরুরি চিকিৎসা: জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসা জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর হৃদপিণ্ডের পেশিগুলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, যা তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। জরুরি চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হলো রক্ত প্রবাহ পুনরায় চালু করা এবং হৃদপিণ্ডের পেশিগুলোর ক্ষতি সীমিত করা। তাই রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়া এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শুরু করা না হলে হৃদপিণ্ডে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, যা পরবর্তীতে কার্ডিয়াক ফেইলিউর বা আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়।
জরুরি চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হলেও এটি সময়মতো শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। তাই হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায় নাকি মারা যায় না সেটা নির্ভর করছে সঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ নেয়ার উপর। সুসংগঠিত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীকে প্রথমে অক্সিজেন সরবরাহ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, এবং ব্যথা উপশমের জন্য যথাযথ ওষুধ দেওয়া হয়। অনেক সময় জরুরি ভিত্তিতে রক্ত জমাট বাঁধা ভাঙার ওষুধ (থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি) প্রয়োগ করা হয়, যা রোগীর অবস্থা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে। জরুরি চিকিৎসার গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ালে হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুহার অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
প্রাথমিক পদক্ষেপ: CPR এবং অ্যাসপিরিন
হার্ট অ্যাটাকের সময় প্রাথমিক পদক্ষেপ রোগীর জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যদি রোগী হঠাৎ জ্ঞান হারায় এবং শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তবে দ্রুত কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (CPR) শুরু করা উচিত। CPR-এর মাধ্যমে হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ চালু রাখা যায় এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছানো নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি কমিয়ে এনে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য সময় তৈরি করে। CPR সঠিকভাবে প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষিত ব্যক্তির প্রয়োজন, তবে সাধারণ মানুষকেও এর প্রাথমিক নিয়মাবলী শিখতে উৎসাহিত করা উচিত।
অন্যদিকে, অ্যাসপিরিন হার্ট অ্যাটাকের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর। অ্যাসপিরিন রক্ত পাতলা করতে সাহায্য করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ধীর করে দেয়। এটি রক্ত প্রবাহ পুনরায় চালু করার একটি তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। রোগী যদি জ্ঞান না হারিয়ে থাকেন, তবে দ্রুত একটি অ্যাসপিরিন চিবিয়ে খেতে দেওয়া উচিত। তবে এর মাত্রা এবং প্রয়োগের সঠিক নিয়ম সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। CPR এবং অ্যাসপিরিনের সম্মিলিত প্রয়োগ প্রাথমিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
আধুনিক চিকিৎসা: এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এনজিওপ্লাস্টি হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর এবং বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। এনজিওপ্লাস্টি হল একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ব্লক হয়ে যাওয়া ধমনীতে একটি বিশেষ ধরনের বেলুন ঢোকানো হয় এবং ফোলানো হয়, যা ধমনীতে জমাট বাঁধা রক্ত বা চর্বি সরিয়ে রক্তপ্রবাহ পুনরায় চালু করে। অনেক ক্ষেত্রে একটি ধাতব স্টেন্ট ধমনীতে স্থাপন করা হয়, যা ধমনীকে খোলা রাখতে সাহায্য করে। এটি হার্ট অ্যাটাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পেশিকে পুনরায় কার্যকর করতে সাহায্য করে।
বাইপাস সার্জারি হলো আরেকটি উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি, যা গুরুতর অবস্থা মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়। যখন ধমনীগুলোতে একাধিক ব্লক থাকে এবং এনজিওপ্লাস্টি কার্যকর নয়, তখন বাইপাস সার্জারি করা হয়। এই পদ্ধতিতে শরীরের অন্য কোনো ধমনীর অংশ ব্যবহার করে হার্টে রক্ত চলাচলের জন্য বিকল্প পথ তৈরি করা হয়। এটি সময়সাপেক্ষ এবং জটিল একটি পদ্ধতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে রোগীর জীবনের মান উন্নত করতে এবং পরবর্তী হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
গোল্ডেন আওয়ার: সঠিক সময়ে চিকিৎসার গুরুত্ব
হার্ট অ্যাটাকের প্রথম এক ঘণ্টা, যা “গোল্ডেন আওয়ার” নামে পরিচিত, রোগীর জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায় কিনা তা আমাদের উপরেই অনেকাংশে নির্ভরশীল। অর্থাৎ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে হৃদপিণ্ডের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এই সময়ের মধ্যে এনজিওপ্লাস্টি বা থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি দেওয়া হলে রক্তপ্রবাহ পুনরায় চালু করা যায় এবং হার্টের পেশি স্থায়ী ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। অনেক সময় রোগীরা লক্ষণগুলো অবহেলা করেন এবং চিকিৎসা নিতে দেরি করেন, যা মৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
গোল্ডেন আওয়ারের সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রোগী এবং তাদের পরিবারের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে বা নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করতে পারলে হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুহার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই এই সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যতালিকা থেকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার বাদ দেওয়া উচিত, কারণ এগুলো রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। চর্বিযুক্ত মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, এবং ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এর পরিবর্তে শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ যেমন সালমন ও সার্ডিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই খাবারগুলো হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়াতে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
খাবারে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করাও অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। দিনে ৫ গ্রামের বেশি লবণ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত চিনি সমৃদ্ধ খাবার কমিয়ে আনা উচিত, কারণ এগুলো ওজন বৃদ্ধি এবং ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধু হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধেই নয়, বরং সার্বিক শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতেও সহায়ক।
ধূমপান ও মদ্যপানের প্রভাব
ধূমপান এবং মদ্যপান হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। ধূমপানের ফলে ধমনীর প্রাচীরে ক্ষতি হয় এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, যা ধমনীতে জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ায়। এটি রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং হৃদপিণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া ধূমপানের নিকোটিন এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ধমনী সংকুচিত করে, যা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। ধূমপান ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব কমতে শুরু করে, এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
অন্যদিকে অতিরিক্ত মদ্যপানও হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর। এটি রক্তচাপ বাড়ায় এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা ধমনীতে চর্বি জমার কারণ হতে পারে। যদিও কিছু গবেষণায় সীমিত পরিমাণ অ্যালকোহল গ্রহণ উপকারী হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে এই সীমা অতিক্রম করলেই তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত মদ্যপান হার্টের পেশি দুর্বল করে এবং হার্ট ফেইলিউরের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে ধূমপান ও মদ্যপান পুরোপুরি ত্যাগ করাই সর্বোত্তম।
মানসিক চাপ ও শারীরিক ব্যায়ামের ভূমিকা
মানসিক চাপ হৃদরোগের অন্যতম গোপন কারণ হিসেবে কাজ করে। দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপ থাকলে শরীরে কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিনের মতো হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। মানসিক চাপের ফলে অনেকেই ধূমপান, অতিরিক্ত খাবার খাওয়া, বা অ্যালকোহল গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করেন, যা আরও ক্ষতিকর। তাই মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের মতো পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। নিয়মিত বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত ঘুমও মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
অন্যদিকে, শারীরিক ব্যায়াম হার্টের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। নিয়মিত ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্তে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়, এবং অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের মাঝারি-তীব্রতার ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাইক্লিং, বা সাঁতার, হৃদরোগের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। ব্যায়ামের অভ্যাস শুধু হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে নয়, বরং মানসিক সুস্থতাও বজায় রাখে। তাই মানসিক চাপ এড়ানো এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিশেষে,
হার্ট অ্যাটাক হলে কি মারা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- হার্ট অ্যাটাক মানেই মৃত্যু নয়। এটি চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এখন হার্ট অ্যাটাকের পর বাঁচার হার অনেক বেড়েছে। তবে জীবন বাঁচাতে সচেতনতা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সময়মতো চিকিৎসা, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং সুস্থ জীবনধারা বেছে নিলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব।
তাই বলা যায়, সঠিক পদক্ষেপ এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হার্ট অ্যাটাকের ভয়াবহতাকে আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই আসুন, হৃদরোগ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করি, ভালোবাসি নিজেদের এবং চারপাশের মানুষদের। তাই যতটা পারেন আপনার আশেপাশের মানুষদের সচেতন করে তুলুন। জীবন একবারই পাওয়া যায়, সেটিকে সুরক্ষিত রাখতে হবে আমাদেরই।