কিভাবে প্রতিরোধ করবেন হৃদরোগ? কিছু সহজ অভ্যাসেই নিরাপদ হার্ট!

কিভাবে প্রতিরোধ করবেন হৃদরোগ

“একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না!”

ভোরবেলা অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন রহমান সাহেব। হঠাৎ বুকে চিনচিনে ব্যথা- কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে ব্যথা হয়ে উঠল অসহনীয়। আর হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সব শেষ। বাংলা সিনেমায় ঘটতে দেখা যাওয়া এমন ঘটনা আজকাল বাস্তবেও যেন খুব সাধারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ১.৭ কোটি মানুষ মারা যান হার্টের রোগে, যার মধ্যে অনেকেই ৪০ বছরের নিচে। ভয়ঙ্কর হলেও সত্য, এদের বেশিরভাগ মৃত্যু রোধ করা যেত -যদি সময় থাকতে সতর্ক হওয়া যেত। তাই আজকের এই লেখায় আমরা জানব, কিভাবে প্রতিরোধ করবেন হার্টের রোগ।

বর্তমানে বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাক আর উচ্চ রক্তচাপ যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে। ফাস্টফুড, ধূমপান, মানসিক চাপ, ঘুমের অনিয়ম -এসবই আমাদের হার্টকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। National Heart Foundation of Bangladesh-এর মতে, বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হার্টের সমস্যায় পড়ার ঝুঁকিতে আছেন। অথচ একটু সচেতনতা থাকলেই, অকালমৃত্যু নয়- জীবন হয়ে উঠবে আরো দীর্ঘ, সুস্থ এবং প্রাণবন্ত।

হার্টের রোগ কেন হয়?

হার্টের রোগ কেন হয় তা বোঝার জন্য আমাদের হৃদপিণ্ডের কার্যপ্রণালী ও তার সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলোর দিকে তাকানো জরুরি। হৃদরোগ সাধারণত তখনই হয় যখন হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে করোনারি ধমনিতে চর্বি, কোলেস্টেরল ও অন্যান্য পদার্থ জমে প্ল্যাক তৈরি হলে। এই জমে থাকা প্ল্যাক ধমনিগুলোকে সরু করে দেয়, ফলে হৃদপিণ্ডে প্রয়োজনীয় পরিমাণে রক্ত এবং অক্সিজেন পৌঁছায় না। এর ফলে অ্যাঞ্জিনা (বুকে ব্যথা), হার্ট অ্যাটাক বা হৃদপিণ্ডে স্থায়ী ক্ষতির মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনের মতো কারণগুলো হৃদরোগের সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ, অনিয়মিত জীবনযাপন ও পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপের অভাবও এই রোগের অন্যতম কারণ।

এছাড়া, খাদ্যাভ্যাসও হার্টের রোগ হওয়ার পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত লবণ, ট্রান্স ফ্যাট, প্রসেসড ফুড এবং চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ধমনির প্রাচীরে চর্বি জমার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত শাকসবজি, ফলমূল, পূর্ণ শস্য এবং স্বাস্থ্যকর চর্বির অভাবও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও হার্টের রোগ হতে পারে, অর্থাৎ পরিবারের কেউ এই রোগে আক্রান্ত থাকলে অন্য সদস্যদের মধ্যে এর সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই হার্টের রোগ প্রতিরোধ করতে হলে সচেতন জীবনযাপন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার দিকে মনোযোগী হওয়া খুবই জরুরি।

কিভাবে প্রতিরোধ করবেন হৃদরোগ?

আমরা জানি যে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই কিছু সাধারণ অভ্যাসের মাধ্যমেই আমরা প্রাণনাশক এই ব্যধি থেকে মুক্তি পেতে পারি খুব সহজেই। চলুন জেনে নিই এমন কিছু উপায়- 

সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন

সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ হার্ট সুস্থ রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় তাজা ফলমূল, সবুজ শাকসবজি, উচ্চ ফাইবারযুক্ত শস্য (যেমন: ওটস, বাদামি চাল, চিয়া সিডস) এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (যেমন: সালমন, সারডিন, টুনা) রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। এইসব খাবার শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া ফলমূল ও শাকসবজি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর, যা ধমনির ক্ষয় রোধ করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

অন্যদিকে অতিরিক্ত লবণ, তেল, চিনি ও প্রসেসড খাবার হার্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসের মতো হৃদরোগের পূর্বাভাস তৈরি করে। তাই খাদ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া জরুরি। প্রতিদিনের খাদ্যে বাড়তি চর্বি, রেড মিট ও ফাস্ট ফুড বাদ দিয়ে, পরিবর্তে গ্রিলড বা সিদ্ধ খাবার বেছে নেওয়া উচিত। এছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান করাও রক্ত সঞ্চালন ও হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা ভালো রাখতে সাহায্য করে। ভালো খাদ্যাভ্যাস মানে শুধু হার্ট নয়, পুরো শরীরের জন্য উপকার।

নিয়মিত ব্যায়াম করুন (কমপক্ষে সপ্তাহে ৫ দিন)

নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন, দিনে ৩০ মিনিট করে হাঁটা, হালকা দৌড় (জগিং), সাইক্লিং, বা সাঁতার শরীরকে সক্রিয় রাখে এবং হার্টকে সুস্থ রাখে। এই ধরনের কার্ডিও এক্সারসাইজ রক্ত চলাচল উন্নত করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। এর ফলে হৃদযন্ত্রের উপর চাপ কম পড়ে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

এছাড়াও ব্যায়াম আমাদের মেটাবলিজম উন্নত করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা সরাসরি হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ কমায়। অনেক সময় হৃদরোগের একটি বড় কারণ হয় অতিরিক্ত ওজন ও মেদবহুলতা। ব্যায়াম শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো রাখে -মানসিক চাপ কমায়, ঘুমের মান বাড়ায়, এবং মন ভালো রাখে। সব মিলিয়ে, প্রতিদিনের জীবনে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের শরীরচর্চা যুক্ত করা হৃদরোগ প্রতিরোধের একটি কার্যকর পদ্ধতি।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করুন

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য হৃদপিণ্ডের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদানগুলোর একটি। এতে থাকা নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড ধমনি সংকোচন করে, রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে এবং রক্তচাপ ও হার্ট রেট বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ধমনিতে প্ল্যাক জমার সম্ভাবনা বাড়ে, যা অবশেষে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি প্যাসিভ স্মোকারদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঝুঁকি থেকে যায়, যা অনেকেই এড়িয়ে যান।

ধূমপান ছাড়লে শরীর ধীরে ধীরে নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করে। ধূমপান বন্ধ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রক্তচাপ ও হার্ট রেট স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। তাই তামাকজাত দ্রব্য একেবারে বর্জন করাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ ও কাউন্সেলিং গ্রহণ খুবই কার্যকর হতে পারে।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে তা হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে হৃদপিণ্ডকে রক্ত সঞ্চালনের জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয়, ফলে তার উপর বাড়তি চাপ পড়ে। এতে উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ও উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো সমস্যা তৈরি হয়, যেগুলো একত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে হৃদস্পন্দনের অনিয়ম এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে শুধু হার্ট নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং নিয়মিত ব্যায়াম। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘন ঘন প্রসেসড খাবার ও চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত। একটি সুস্থ ও সঠিক ওজন ধরে রাখলে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বডি মাস ইনডেক্স (BMI) পর্যবেক্ষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।

মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন

মানসিক চাপ শুধু মস্তিষ্ক নয়, হৃদপিণ্ডকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়ায়, হরমোন ভারসাম্য বিঘ্নিত করে এবং হৃদপিণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এর ফলে হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে ও হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘ সময় মানসিক চাপে থাকেন, তাদের মধ্যে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক বা হৃদযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, এবং পর্যাপ্ত ঘুম খুবই কার্যকরী পদ্ধতি। প্রতিদিন অন্তত ১৫–২০ মিনিট শান্ত পরিবেশে বসে চোখ বন্ধ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলে মন প্রশান্ত হয় এবং শরীরও সতেজ থাকে। মানসিক চাপ কমাতে পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, পছন্দের কাজ করা, এবং প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং নেওয়াও সহায়ক হতে পারে। মানসিক স্বস্তি মানেই হৃদয় সুস্থ রাখার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ।

রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করান নিয়মিত

রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল -এই দুটি উপাদান অনেক সময় নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তারা উচ্চ রক্তচাপ বা উচ্চ কোলেস্টেরলে ভুগছেন, কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এসব সমস্যার কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। অথচ এই দুটি সমস্যা ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক কিংবা হার্ট অ্যাটাকের দিকে ঠেলে দেয়। নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে সময়মতো সমস্যা শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

প্রতিনিয়ত রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করলে হৃদরোগ প্রতিরোধে বড় ধরণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। যদি দেখা যায় কোন মান স্বাভাবিকের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ও জীবনযাপনে শৃঙ্খলা আনা জরুরি। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি মাত্রেই প্রতি ৩-৬ মাস অন্তর এগুলোর পরীক্ষা করিয়ে নেন, যাতে তারা নিজের হৃদয় ও শরীরের যত্ন নিতে পারেন সময়মতো।

অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ এড়িয়ে চলুন

অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। অ্যালকোহল সরাসরি রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, হৃদস্পন্দনের অনিয়ম ঘটায় এবং ট্রাইগ্লিসারাইড নামক একধরনের চর্বির মাত্রা রক্তে বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে রক্তনালীগুলো সরু হয়ে যেতে পারে এবং ধমনিতে ব্লক তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই মনে করেন মাঝেমধ্যে অল্প পরিমাণে পান করলে ক্ষতি হয় না, তবে নিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যালকোহল গ্রহণ করলে তা দীর্ঘমেয়াদে হার্টের গঠন ও কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এছাড়া অ্যালকোহল লিভার, কিডনি ও মস্তিষ্কের পাশাপাশি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, যা পরোক্ষভাবে হার্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি অ্যালকোহল নির্ভরশীলতা মানসিক চাপও বাড়ায় -যা নিজেই হৃদরোগের একটি প্রধান কারণ। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধে অ্যালকোহল গ্রহণ পুরোপুরি বন্ধ করাই সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা। যদি কেউ সম্পূর্ণভাবে ছাড়তে না পারেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে সীমিত মাত্রায় গ্রহণ এবং তার ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ও হার্ট চেকআপ করান

হার্ট সুস্থ রাখার জন্য শুধু সচেতন জীবনযাপন নয়, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও হার্ট চেকআপও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স ৩০ পেরোলেই, বিশেষ করে যদি পারিবারিক ইতিহাসে হৃদরোগ থাকে, তাহলে ECG, ব্লাড প্রেসার চেক, লিপিড প্রোফাইল (কোলেস্টেরল টেস্ট), ইকোকার্ডিওগ্রাম ও প্রয়োজনে স্ট্রেস টেস্ট নিয়মিত করানো উচিত। এইসব পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের অবস্থা আগেভাগেই জানা যায় এবং যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা যায়। অনেক সময় ছোট একটি লক্ষণ বা উপসর্গ (যেমন ক্লান্তি, বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট) বড় সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।

সাধারণত হৃদরোগ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তাই তা নিরব ঘাতকের মতো আচরণ করে। যারা ব্যস্ত জীবনযাপন করেন কিংবা শারীরিক উপসর্গকে অবহেলা করেন, তাদের মধ্যে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। নিয়মিত চেকআপ করলে জীবনধারার উপযুক্ত পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় এবং ওষুধ বা থেরাপির মাধ্যমে সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বছরে অন্তত একবার পরামর্শ করা হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় একেবারে অপরিহার্য।

হৃদরোগের লক্ষণগুলো চেনা জরুরি

হৃদরোগ প্রতিরোধ ও দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো চেনা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় হৃদরোগের লক্ষণগুলো খুব সাধারণ মনে হতে পারে, যেমন বুকে চাপ বা অস্বস্তি, যা মানুষ গ্যাস্ট্রিক বা হজমের সমস্যা ভেবে এড়িয়ে যায়। কিন্তু এটি হতে পারে একটি ‘ওয়ার্নিং সাইন’ -হার্ট অ্যাটাক বা বড় কোনো হৃদরোগের পূর্বাভাস। বুকে ব্যথা বা চাপ ছাড়াও বাঁ কাঁধ, বাহু, পিঠ, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হওয়া, হালকা মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। অনেক সময় এই লক্ষণগুলো তীব্র না হলেও বারবার দেখা দিলে তা অবহেলা করা উচিত নয়।

বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের লক্ষণ অনেক সময় “নীরব” (Silent) হতে পারে, অর্থাৎ তারা ব্যথা তেমন একটা অনুভব করেন না, কিন্তু হৃদপিণ্ডে ক্ষতি হতে থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত ঘাম, হঠাৎ দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা হাঁটলে বা কাজ করলে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া এসব লক্ষণও হৃদরোগের ইঙ্গিত হতে পারে। অনেক নারী, প্রবীণ ও উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো একটু আলাদা বা কম স্পষ্ট হয়। তাই সচেতন থাকাই সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা। নিজের শরীরের সংকেতগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জীবন রক্ষাকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে।

উপসংহার

হার্টের রোগ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসে। সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, ধূমপান পরিহার, ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ -এই সহজ কিছু নিয়ম মেনে চললেই আপনার হার্ট থাকবে সুরক্ষিত। মনে রাখবেন, একটি সচেতন সিদ্ধান্ত পারে একটি জীবন বাঁচাতে। তাই আজকেই নিজেকে প্রশ্ন করুন -কিভাবে প্রতিরোধ করবেন হার্টের রোগ? আর উত্তর খুঁজেই শুধু থেমে যাবেন না, তা বাস্তব জীবনেও প্রয়োগ করুন। কারণ আপনি যতটা গুরুত্ব দেন ক্যারিয়ার, পরিবার বা ভবিষ্যৎকে -ততটাই গুরুত্ব পাওয়া উচিত আপনার নিজের হার্টের।

Related posts

Leave a Comment