হৃদরোগের আগাম লক্ষণ- জীবন বাঁচাতে চিনে রাখুন!

হৃদরোগের আগাম লক্ষণ

বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগের প্রকোপ ভয়ানক হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৭৯ কোটি মানুষ হৃদরোগজনিত কারণে মারা যান, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২%। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই মৃত্যুর অনেকগুলোই প্রতিরোধযোগ্য ছিল যদি আগেভাগে লক্ষণগুলো শনাক্ত করা যেত। আমাদের দেশের মানুষ এখনও অনেকাংশে হৃদরোগের আগাম লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন নয়, যা আমদের জীবনকে দিন দিন করে তুলছে আরো অনিশ্চিত।

অনেকেই মনে করেন হৃদরোগ হঠাৎ করে হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেহ অনেক আগেই এর সংকেত দিতে শুরু করে। কিন্তু আমরা সেসব ইঙ্গিতকে অবহেলা করি। শরীরে হঠাৎ ক্লান্তি, ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ ধরা বা হালকা ব্যথা- এই সবই হতে পারে হৃদরোগের আগাম লক্ষণ। সময়মতো চিকিৎসা বা জীবনধারার পরিবর্তন করলে এগুলোর মাধ্যমেই একটি জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

হৃদরোগের আগাম লক্ষণ: কেন আগেভাগে জানা জরুরি?

হৃদরোগের আগাম লক্ষণগুলো সঠিকভাবে জানা এবং চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ হৃদরোগ প্রায়শই নিঃশব্দে শরীরে গড়ে ওঠে এবং অনেক সময় মারাত্মক হয়ে ওঠে কোনো স্পষ্ট লক্ষণ না দিয়েই। যদি আমরা আগাম কিছু সতর্ক সংকেত চিনে ফেলতে পারি- যেমন অল্প পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট হওয়া, হঠাৎ বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ঘাম, ঘন ঘন ক্লান্তি বা মাথা ঘোরা- তাহলে বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়। এই ধরনের লক্ষণ অনেক সময় সাধারণ শারীরিক সমস্যা বলে ভুল করা হয়, কিন্তু এগুলো হৃদপিণ্ডের সমস্যার একটি পূর্বাভাস হতে পারে। আগাম সনাক্তকরণ মানেই জীবন রক্ষার জন্য সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ।

এছাড়া আগাম লক্ষণগুলো জানা থাকলে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ধূমপানকারী কিংবা পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে এমনরা- নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ করতে পারেন। একটি ছোট লক্ষণ যদি সময়মতো ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে ওষুধ, জীবনধারার পরিবর্তন, অথবা প্রয়োজন হলে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারেন। হার্টের সমস্যা একবার বড় আকার ধারণ করলে, তা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন এবং জীবনঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই সচেতনতা, পর্যবেক্ষণ, এবং আগাম লক্ষণ শনাক্ত করার সক্ষমতাই হৃদরোগ প্রতিরোধের প্রথম ধাপ এবং সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।

হৃদরোগের আগাম লক্ষণ

শরীরের যেসব সংকেত অবহেলা করলে বিপদ বাড়ে 

হালকা বুকে চাপ বা অস্বস্তি

বুকে হালকা চাপ, ভার ভাব বা অস্বস্তি অনেকেই গ্যাস্ট্রিক বা ক্লান্তির লক্ষণ ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু এটি হৃদরোগের অন্যতম প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হতে পারে। কখনো কখনো এই অস্বস্তি ব্যথা হিসেবে না থেকে, শুধু চাপ বা জ্বালাপোড়া হিসেবে অনুভূত হয়, বিশেষ করে বুকের মাঝ বরাবর বা বাঁ পাশে। এই অনুভূতি কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং বিশ্রামে সাময়িকভাবে কমলেও আবার ফিরে আসতে পারে।

এমন অস্বস্তি যদি হাঁটার সময় বা হালকা কাজ করলেও দেখা দেয়, তবে এটি “অ্যাঞ্জাইনা” নামক অবস্থার ইঙ্গিত হতে পারে- যা হার্টে রক্ত চলাচলের অসুবিধার কারণে হয়ে থাকে। যদি সময়মতো এর প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তা হার্ট অ্যাটাকে রূপ নিতে পারে। তাই এমন বুকে চাপ বা অস্বস্তি অনুভব করলে সেটিকে হালকাভাবে না নিয়ে, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বুকের যেকোনো ব্যতিক্রমী অনুভূতি হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা, তা নির্ণয় করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ঘন ঘন ক্লান্তি বা দুর্বলতা

প্রতিদিনের সাধারণ কাজ যেমন হাঁটা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা হালকা গৃহকর্ম করলেও যদি ঘন ঘন ক্লান্তি আসে, তা হতে পারে হৃদরোগের একটি সূচক। বিশেষ করে যারা আগে এমন ক্লান্তি অনুভব করতেন না, তাদের জন্য এটি চিন্তার বিষয়। হার্ট যদি ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে না পারে, তাহলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন পৌঁছায় না, ফলে দুর্বলতা অনুভূত হয়।

অনেক নারী, বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারীদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের আগাম লক্ষণ হিসেবে ক্লান্তি বা অবসাদ প্রথমে দেখা দেয়। এটি এতটাই সাধারণ লক্ষণ যে প্রায়ই গুরুত্ব না দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যদি এই দুর্বলতা দৈনন্দিন জীবনে বাধা সৃষ্টি করে, কিংবা বিশ্রামের পরও না কমে, তাহলে তা অবহেলা না করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ এই ছোট্ট লক্ষণই হতে পারে একটি বড় বিপদের শুরু।

ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট বা ঘুম ভেঙে যাওয়া

রাতে ঘুমানোর সময় শ্বাসকষ্ট হওয়া, হঠাৎ ঘুম ভেঙে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা বুকে চাপ অনুভব করা- এই লক্ষণগুলো হৃদযন্ত্রের সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। বিশেষ করে হার্ট ফেলিওর বা কনজেস্টিভ হার্ট ফেইল্যারের রোগীদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই অবস্থায় ফুসফুসে অতিরিক্ত তরল জমে যায়, যা শ্বাসপ্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটায় এবং রাতে শুয়ে থাকা অবস্থায় তীব্র হয়ে ওঠে।

এমন সমস্যা উপেক্ষা করা মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে। অনেকে এটিকে ফুসফুস বা নিঃশ্বাসের সাময়িক সমস্যা ভেবে ভুল করেন। কিন্তু ঘন ঘন এমন অভিজ্ঞতা হলে তা হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে। তাই ঘুমের মধ্যে যদি বারবার শ্বাসকষ্টের কারণে জেগে উঠতে হয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত হার্ট চেকআপ করানো উচিত। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

অনিয়মিত হার্টবিট বা বুক ধড়ফড় করা

হৃদস্পন্দনের অনিয়ম- অর্থাৎ খুব ধীরে, খুব দ্রুত, অথবা অসমান গতিতে হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করা- হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। অনেক সময় এটি সাময়িক স্ট্রেস, কফির প্রভাব, কিংবা ঘুমের ঘাটতির কারণে হয়েও থাকতে পারে, কিন্তু যদি ঘন ঘন হয় বা শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে তা হতে পারে “এরিদমিয়া” বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ইঙ্গিত। এই অবস্থায় হার্ট ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, যার ফলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

এই লক্ষণ অবহেলা করলে তা হৃদরোগ, স্ট্রোক, বা হঠাৎ হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। বুক ধড়ফড় করলে যদি সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা বুকের ব্যথা থাকে, তাহলে বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। তাই হার্টবিট অনিয়মিত লাগলে তা যাচাইয়ের জন্য ইসিজি (ECG), হোল্টার মনিটর বা ইকোকার্ডিওগ্রামের মতো পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সময়মতো পদক্ষেপ নিলে জীবনহানির ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়।

কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন? 

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগী

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হার্টের অন্যতম প্রধান শত্রু। দীর্ঘদিন ধরে রক্তচাপ যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে তা হৃদপিণ্ডের ধমনীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে ধমনিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করতে হয়, যার ফলস্বরূপ হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং হার্ট ফেলিওরের আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ থাকলে স্ট্রোক, কিডনি জটিলতা এবং আচমকা হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

অন্যদিকে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, তা ধমনিগুলোকে সরু করে দেয় এবং রক্ত চলাচলের ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে হৃদপিণ্ড প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আরও আশঙ্কাজনক হলো- ডায়াবেটিসের কারণে হৃদরোগের লক্ষণ অনেক সময় অনুভূত হয় না, ফলে সমস্যা বুঝে ওঠার আগেই তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। তাই এই দুই ধরনের রোগীদের নিয়মিত চেকআপ, ওষুধ সেবন এবং জীবনধারার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।

ধূমপান বা অতিরিক্ত মদ্যপানকারীরা

ধূমপান হৃদরোগের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তামাকের ধোঁয়ার মধ্যে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি রক্তনালীর ক্ষতি করে এবং ধমনিগুলোকে সংকুচিত করে তোলে। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয় এবং ধমনিতে কোলেস্টেরল জমে ব্লক তৈরি হয়, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা তৈরি করে। এছাড়া ধূমপান রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে হৃদপিণ্ডকে বেশি খাটতে হয়- যা দীর্ঘমেয়াদে তার উপর চাপ সৃষ্টি করে।

অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণও হৃদরোগের একটি বড় কারণ। অ্যালকোহল রক্তচাপ ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে এবং হার্টের পেশিগুলোকে দুর্বল করে দেয়। নিয়মিত মদ্যপান হার্টের স্বাভাবিক ছন্দে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, যা এরিদমিয়া বা অনিয়মিত হার্টবিটের দিকে ধাবিত করে। অনেকে মনে করেন মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে পান করলে ক্ষতি হয় না, কিন্তু অভ্যাসে পরিণত হলে এটি হার্টসহ লিভার, ব্রেইন এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। তাই ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকাই হৃদরোগ প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ পথ।

মানসিক চাপে থাকা কর্মজীবী মানুষ

বর্তমান যুগে কর্মজীবী মানুষেরা অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, যা হৃদরোগের একটি নীরব কিন্তু শক্তিশালী কারণ। অফিসের চাপ, সময়মতো কাজ শেষ করার তাগিদ, পারিবারিক টেনশন বা আর্থিক অনিশ্চয়তা- সবকিছু মিলে মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ তৈরি করে। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ থাকলে শরীরের কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাড়ে, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং হৃদরোগের আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

মানসিক চাপ শুধু শারীরিকভাবেই নয়, জীবনযাপনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যারা দীর্ঘ সময় চাপে থাকেন, তাদের মধ্যে ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ, অপর্যাপ্ত ঘুম, অনিয়মিত খাওয়া বা এক্সারসাইজ না করার প্রবণতা দেখা যায়- যা সবই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ কারণে কর্মজীবী মানুষদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নিয়মিত মেডিটেশন, সময়মতো বিশ্রাম, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং প্রয়োজনে মনোবিদের সঙ্গে পরামর্শ করা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

হৃদরোগের আগাম লক্ষণ দেখে প্রতিরোধ করার উপায়

হৃদরোগের আগাম লক্ষণ দেখে প্রতিরোধ করার উপায়

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর একটি উপায়। অনেক সময় হৃদরোগের লক্ষণগুলো শরীরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, কিন্তু আমরা তা বুঝে উঠি না। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, রক্তে শর্করার মাত্রা বা হরমোনের ভারসাম্য- এসব বিষয় নিয়মিত পরীক্ষা করালে আগেই বোঝা যায় কোন ঝুঁকিতে রয়েছি। ECG, ইকোকার্ডিওগ্রাম বা ট্রপোনিন টেস্টের মতো পরীক্ষাগুলো হৃদপিণ্ডের অবস্থা যাচাই করতে সাহায্য করে এবং কোনো ধরনের অসংগতি থাকলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দেয়।

বিশেষ করে যারা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়েন- যেমন ডায়াবেটিস, স্থূলতা, পরিবারের কারও হৃদরোগের ইতিহাস বা ধূমপায়ী- তাদের জন্য বছরে একবার পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় সামান্য উচ্চ কোলেস্টেরল বা রক্তচাপের ফলে বড় বিপদ ঘটতে পারে, যদি তা সময়মতো ধরা না পড়ে। তাই আগাম লক্ষণ দেখা না গেলেও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হৃদরোগ প্রতিরোধের একটি বাস্তব, ফলপ্রসূ এবং জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপ।

সুষম খাদ্য ও শরীরচর্চা

হৃদয়বান্ধব জীবনযাপনের অন্যতম মূল চাবিকাঠি হলো সুষম খাদ্য ও নিয়মিত শরীরচর্চা। ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ, তাজা শাকসবজি, ফলমূল, উচ্চ ফাইবারযুক্ত শস্য এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী। লবণ ও চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। ফাস্ট ফুড, প্রসেসড খাবার ও অতিরিক্ত তেল-চর্বিজাত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই উচিত।

শরীরচর্চা হৃদপিণ্ডের সক্ষমতা বাড়াতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, সাইক্লিং, সাঁতার বা হালকা ব্যায়াম হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমতে দেয় না এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত শরীরচর্চা ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়ায়, স্ট্রেস হরমোন কমায় এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করে, যা সবই হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর। এমনকি যাদের আগাম কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তারাও জীবনধারায় পরিবর্তন এনে হৃদরোগের গতি থামাতে পারেন।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ

মানসিক চাপ হৃদরোগের নীরব ঘাতক। দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়ায় এবং রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে। এই অবস্থায় হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং ধীরে ধীরে জটিলতা তৈরি হতে থাকে। তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

স্ট্রেস কমাতে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং সময়মতো বিশ্রাম খুবই কার্যকর পন্থা। এছাড়া কাছের মানুষদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা, পছন্দের কাজ করা বা প্রকৃতির কাছে সময় কাটানো মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা মনোবিদের সহায়তা নেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ। মানসিক চাপ কম থাকলে হৃদরোগ প্রতিরোধ অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে।

হৃদরোগ মানেই বুকের ব্যথা – সত্যি নয়

হৃদরোগের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত যে লক্ষণটির কথা সবচেয়ে বেশি শুনে থাকি তা হলো বুকের ব্যথা। যদিও বুকের ব্যথা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত লক্ষণ, তবে সবসময় হৃদরোগ মানেই বুকের ব্যথা হবে- এ ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। অনেক সময় হৃদরোগের লক্ষণগুলো একেবারেই ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। হালকা বুকে চাপ বা অস্বস্তি ছাড়াও অতিরিক্ত ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ ঘাম, মাথা ঘোরা, পিঠ বা চোয়ালে ব্যথা, এমনকি হজমের সমস্যার মতো উপসর্গও হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। বিশেষ করে নারীদের, ডায়াবেটিস রোগী ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এসব “নীরব লক্ষণ” বেশি দেখা যায়, যা প্রায়শই অবহেলিত হয়।

এছাড়া অনেক সময় হৃদরোগ ধীরে ধীরে শরীরে গড়ে ওঠে, ফলে তীব্র কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না, কিন্তু ধমনীতে প্ল্যাক জমে সংকোচন সৃষ্টি করে। এতে একসময় রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। তাই শুধুমাত্র বুকের ব্যথাকে হৃদরোগের একমাত্র উপসর্গ ধরে নেওয়া ভুল। শরীরের যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, বারবার ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা বা ঘুমের সমস্যা দেখা দিলে তা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। সময়মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ হৃদরোগকে আগেভাগে শনাক্ত করে প্রতিরোধের সুযোগ তৈরি করে, যা জীবন বাঁচাতে পারে।

শেষ কথা,

তবে সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো- হৃদরোগ কেবল বয়স্কদেরই নয়, আজকাল তরুণরাও এর শিকার হচ্ছেন। গবেষণা বলছে, ৩০ বছর বয়সের নিচেও অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার মূল কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও অনিয়মিত জীবনযাপন। তাই সময় এসেছে সচেতন হওয়ার, হৃদরোগের আগাম লক্ষণ গুলো চেনার ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। মনে রাখবেন- আগাম সচেতনতাই দিতে পারে যেকোন রোগ থেকে সহজ মুক্তি।

Related posts

Leave a Comment