মনে করুন, আপনার খুব কাছের একজন মানুষ হঠাৎ করে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আপনি হতভম্ব- কি করবেন, কাকে ডাকবেন, কোথা থেকে শুরু করবেন? এমন পরিস্থিতি যে কারও জীবনে আসতে পারে এবং তখন এক মিনিট সময়ও হতে পারে জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ৪০% রোগী চিকিৎসা পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো- অনেকেই জানেন না হার্ট অ্যাটাকের পর করণীয় ঠিক কী হওয়া উচিত, যার ফলে অনেক সময় মূল্যবান জীবন হারিয়ে যায়। এই আর্টিকেলে আপনি জানবেন, হার্ট অ্যাটাকের পর দ্রুত করণীয় কী কী, কিভাবে প্রাথমিকভাবে রোগীকে সঠিকভাবে সাহায্য করবেন, এবং কোন ভুলগুলো এড়িয়ে চলা জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, হার্ট অ্যাটাক এখন শুধুমাত্র বয়স্কদের নয়- ৩০ বছরের নিচে থাকা তরুণদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। একমাত্র সচেতনতা আর সঠিক পদক্ষেপই পারে এই মৃত্যুর হার কমাতে। আপনি যদি জানেন হার্ট অ্যাটাকের পর করণীয় কী, তাহলে হয়তো আপনি আপনার প্রিয় মানুষটিকে সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারবেন, CPR দিতে পারবেন, কিংবা জরুরি ওষুধ দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারবেন। আর্টিকেলটি পড়ে আপনি কেবল তথ্য জানবেন না, বরং একজন জীবন রক্ষাকারী হয়ে উঠতে পারবেন। তাই আর দেরি না করে পুরো লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, কারণ এখানে প্রতিটি লাইনে থাকতে পারে কারও জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি।
হার্ট অ্যাটাকের পর করণীয়: জীবন বাঁচাতে প্রথম ১০ মিনিটে কী করবেন?
হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম ১০ মিনিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ের সঠিক পদক্ষেপ জীবন বাঁচাতে পারে। নিচে এ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হলো।
দ্রুত বিপদের চিহ্ন শনাক্ত করুন
হার্ট অ্যাটাক কখনও কখনও হঠাৎ করে ঘটে, আবার অনেক সময় ধীরে ধীরে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই সময় নষ্ট না করে লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করতে হবে। সাধারণত সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ হলো বুকের মাঝখানে চেপে ধরা বা পাথরের মতো ভারী কিছু বসে থাকার অনুভূতি। এই ব্যথা ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হতে পারে এবং মাঝে মাঝে থেমে আবার শুরু হয়। এই ব্যথা কাঁধ, বাঁ হাত (বিশেষ করে), ঘাড়, চোয়াল বা পিঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় ব্যথা ছাড়া শুধু ঘাম, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, বমি ভাব বা মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে- বিশেষ করে মহিলাদের ও ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে।
এই লক্ষণগুলো যদি কারও মধ্যে হঠাৎ দেখা দেয়, বিশেষ করে যদি সে আগে থেকে হৃদরোগে ভুগে থাকে, তাহলে আর সময় না নিয়ে ধরে নিতে হবে- সে হার্ট অ্যাটাক করছে বা করতে যাচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়াই জীবন বাঁচাতে সহায়ক হবে।
জরুরি চিকিৎসা সহায়তা ডাকুন (৯৯৯ বা স্থানীয় নম্বরে ফোন করুন)
হার্ট অ্যাটাকের সময় দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া না গেলে হৃদপিণ্ডের পেশি অক্সিজেনের অভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া মাত্র কয়েক মিনিটে শুরু হয়। তাই এক মুহূর্তও দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জরুরি নম্বরে (যেমন বাংলাদেশে ৯৯৯) ফোন করতে হবে।

অনেকে মনে করেন, হাসপাতালে গাড়ি চালিয়ে নেওয়াটাই দ্রুততম উপায়- কিন্তু তা ভুল। অ্যাম্বুলেন্সে ট্রাফিক ছাড়, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং প্রশিক্ষিত কর্মী থাকে, যা জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফোন করার সময় রোগীর নাম, অবস্থান, লক্ষণ এবং কী কী করা হয়েছে- এসব সংক্ষেপে জানিয়ে দিন।
অ্যাসপিরিন খাওয়ান (যদি অ্যালার্জি না থাকে)
হার্ট অ্যাটাক সাধারণত রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে ঘটে, যা হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। অ্যাসপিরিন হলো একটি রক্ত পাতলা করার ওষুধ যা এই জমাট বাঁধা রক্তকে গলিয়ে দিতে সাহায্য করে এবং আরেকটি অ্যাটাক প্রতিরোধে কার্যকর।
তবে এটি খাওয়ানোর আগে নিশ্চিত হোন, রোগী অ্যাসপিরিনে অ্যালার্জিক নয় বা পূর্বে চিকিৎসক এটি খেতে মানা করেননি। যদি না থাকে, তাহলে একটি ৩০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট চিবিয়ে খাওয়ানো ভালো- কারণ চিবিয়ে খেলে ওষুধ দ্রুত কাজ শুরু করে।
তবে এটি করেও অবশ্যই অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে- এই ওষুধ হার্ট অ্যাটাক পুরোপুরি থামায় না, শুধু সাময়িক সহায়তা করে।
রোগীকে আরামদায়ক অবস্থায় রাখুন
হার্ট অ্যাটাকের সময় রোগীর শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়, তাই তাকে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে সে সহজে শ্বাস নিতে পারে। আধাশোয়া অবস্থায় রাখা সবচেয়ে ভালো- যেখানে পিঠ সাপোর্ট পায় এবং মাথা কিছুটা উঁচুতে থাকে।
রোগী যদি হাঁটাচলা করার চেষ্টা করে, বা কোনো কারণে উঠে দাঁড়ায়, তাহলে তার হৃদপিণ্ডে আরও চাপ পড়ে এবং পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। অতএব, তাকে নিশ্চিন্ত ও স্থির রাখুন। আশ্বস্ত করুন যেন ভয় না পায়- ভয়ের কারণে হৃদস্পন্দন আরও বেড়ে যেতে পারে।
কোনোভাবেই জোর করে পানি খাওয়ানো, ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ বা অনর্থক নড়াচড়া করানো উচিত নয়।
সিপিআর (CPR) প্রয়োগ করুন, যদি নিঃশ্বাস না নেয় বা অজ্ঞান হয়ে যায়
যদি রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় এবং নিঃশ্বাস নিচ্ছে না বা পালস পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে তাকে রক্ষা করতে সিপিআর শুরু করতে হবে।
সিপিআর মানে হচ্ছে- হৃদপিণ্ডে চাপ প্রয়োগ করে কৃত্রিমভাবে রক্ত চলাচল সচল রাখা।
সিপিআর করার পদ্ধতি (হাত দিয়ে চাপ দেওয়া):
- রোগীকে সমতল স্থানে শোয়ান।
- আপনার দুই হাত একসাথে করে বুকের মাঝখানে রাখুন (স্তনদ্বয়ের মাঝখানে)।
- প্রতি মিনিটে ১০০–১২০ বার গতিতে চাপ দিন (প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দুইবার)।
- চাপ এমনভাবে দিন যাতে বুক অন্তত ৫–৬ সেন্টিমিটার নিচে যায়।
- মুখে শ্বাস দেওয়া না জানলে শুধু বুকে চাপ দিলেই হবে (hands-only CPR)।
এই কাজটি চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায়, বা রোগী নিজে থেকে শ্বাস নিতে শুরু করে।
অপ্রয়োজনীয় কিছু করবেন না- ঘরোয়া টোটকা, খাবার বা পানি দেবেন না
এই সময় আতঙ্কে বা লোকমুখে শোনা উপায়ে মানুষ ভুল কাজ করে ফেলতে পারে, যা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। যেমন-
- ঠাণ্ডা পানি খাওয়ানো
- শরীর ঘষে তেল মালিশ করা
- নাকের কাছে পেঁয়াজ ধরা
- জোর করে হাঁটানো বা বসানোর চেষ্টা
এসব কাজ কিছুতেই করা উচিত নয়। রোগীকে যতটা সম্ভব স্থির রেখে, জরুরি সাহায্যের অপেক্ষা করতে হবে। যে কোনো ভুল পদক্ষেপ তার অবস্থাকে আরও খারাপ করে দিতে পারে।
এই নিয়মগুলো সঠিকভাবে জানা ও প্রয়োগ করলে হার্ট অ্যাটাকের পর একজন মানুষকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের সবারই উচিত এগুলো পরিবারের সকল সদস্যকে জানানো এবং সম্ভব হলে প্রাথমিক চিকিৎসা (First Aid & CPR) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা।
হার্ট অ্যাটাক কেন হয়?
হার্ট অ্যাটাক তখন হয়, যখন হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বা আর্টারিতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় বা মারাত্মকভাবে কমে যায়। এই রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের পেশিগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না এবং তা ধীরে ধীরে নষ্ট হতে শুরু করে। সাধারণত এই ব্লক বা বাধা আসে জমাট বাঁধা রক্ত বা ধমনীর দেয়ালে জমে থাকা ফ্যাট, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থ থেকে। এই ব্লক হঠাৎ করে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক হার্ট অ্যাটাক ঘটে।
এর পেছনে অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কারণ থাকে, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান, অনিয়মিত জীবনযাপন, মানসিক চাপ, এবং পারিবারিক ইতিহাস। যখন এগুলো দীর্ঘদিন ধরে শরীরে সক্রিয় থাকে, তখন হৃদপিণ্ডের ধমনীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্লাক (চর্বি, কোলেস্টেরল ইত্যাদির স্তর) জমে যায়। প্লাকের ওপর থাকা পাতলা স্তর যদি ফেটে যায়, তখন তাতে রক্ত জমাট বাঁধে এবং ধমনী বন্ধ হয়ে যায়- এই সময়ই ঘটে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক।
হৃদপিণ্ডের রক্তনালী ব্লক হওয়ার কারণ
হৃদপিণ্ডে তিনটি প্রধান করোনারি ধমনী থাকে, যেগুলো হার্টে অক্সিজেন ও পুষ্টিকর রক্ত সরবরাহ করে। যখন এই ধমনীগুলোর ভেতরে ধীরে ধীরে ফ্যাট, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ জমে যায়, তখন তাকে বলে ‘আথেরোস্ক্লেরোসিস’। এই প্রক্রিয়ায় ধমনীর ভেতরের দেয়াল সরু হয়ে যায়, ফলে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কখনও কখনও জমা থাকা ফ্যাটের স্তর হঠাৎ ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বাঁধে- এবং সেই জমাট ধমনী পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক হয়।

এই ব্লকের জন্য দায়ী অনেকগুলো কারণ থাকে। উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার খাওয়া, ট্রান্স ফ্যাট বা ফাস্ট ফুডের প্রতি আসক্তি, দৈহিক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ, অ্যালকোহল সেবন, এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব- সবকিছু মিলে ধমনীগুলোকে ধীরে ধীরে সংকীর্ণ করে তোলে। অনেকে ভাবেন, বয়স বাড়লে ব্লক হয়, কিন্তু বর্তমানে অল্প বয়সীদের মধ্যেও ব্লকের সমস্যা বাড়ছে, কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন অনেক বেশি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং ধূমপানের প্রভাব
উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। যখন রক্তচাপ বেশি থাকে, তখন ধমনীর দেয়ালের উপর চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে সেই দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে ফ্যাট জমে ধমনী ব্লক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। একইভাবে, এই অতিরিক্ত চাপ হৃদপিণ্ডের পেশিগুলোকেও দুর্বল করে ফেলে, যার ফলে হৃদযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
ডায়াবেটিসও হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম বড় কারণ। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যা ধমনীর প্রাচীরে ক্ষতি করে এবং রক্ত চলাচল ব্যাহত করে। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে অতিরিক্ত ইনসুলিন এবং গ্লুকোজ থাকায় তাদের রক্তনালী দ্রুত প্লাক দ্বারা ভরে যায়। আর ধূমপান হলো আরেকটি মারাত্মক কারণ- তামাকের রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ধমনীকে সংকীর্ণ করে এবং রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে, ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুধু ধূমপানই নয়, প্যাসিভ স্মোকাররাও একই রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
অপ্রত্যাশিত বয়সে হার্ট অ্যাটাক কেন বাড়ছে?
পূর্বে মনে করা হতো হার্ট অ্যাটাক শুধুই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে থাকে, কিন্তু বর্তমানে ৩০–৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের হার চোখে পড়ার মতো বেড়ে গেছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো- অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত বসে থাকা, শরীরচর্চার অনীহা, ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ- সবকিছু মিলিয়ে হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। ফলে বয়স যতই কম হোক না কেন, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাচ্ছে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- চাপ ও মানসিক উদ্বেগ। আধুনিক কর্মজীবনে মানসিক চাপ, সময়ের অভাব, এবং ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে ঘুমের অভাব ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের ঘাটতি হৃদপিণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেক তরুণ নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে- যার ফলাফল হয়তো হঠাৎ একদিন একেবারে প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই অল্প বয়সেও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সচেতন জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি।
অ্যাম্বুলেন্স না প্রাইভেট গাড়ি? রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার সঠিক উপায়
জরুরি অবস্থায় অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান- রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া ভালো, নাকি প্রাইভেট গাড়িতে। বাস্তবে, হার্ট অ্যাটাকের মতো সংকটময় মুহূর্তে অ্যাম্বুলেন্সই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর মাধ্যম। কারণ, একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম যেমন অক্সিজেন সাপোর্ট, ইসিজি মেশিন, ইনজেকশন, এবং প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক স্টাফ থাকে, যারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারে এবং হাসপাতালের আগেই রোগীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারে। এর পাশাপাশি, ট্রাফিকে অগ্রাধিকার পায় বলে অনেক সময় রাস্তায় কম সময়ও লাগে।
অন্যদিকে, প্রাইভেট গাড়িতে চিকিৎসা সহায়তা থাকে না, এবং গাড়ির চালক, আত্মীয়স্বজন- সবাই তখন ভীত ও বিভ্রান্ত থাকে। রাস্তায় যানজট পড়লে গাড়ি দাঁড়িয়ে যেতে পারে, রোগী আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। তবে যদি আপনার এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স বিলম্ব করে বা পাওয়া না যায়, এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর রাস্তা স্পষ্ট ও পরিষ্কার থাকে, তখনই কেবলমাত্র খুব সাবধানে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে- তবে চালক যেন ঠান্ডা মাথায় দ্রুত গাড়ি চালাতে পারেন এবং পাশে কেউ থাকেন রোগীর দেখভালের জন্য।
কীভাবে হাসপাতাল বেছে নেবেন
হার্ট অ্যাটাক বা অন্য কোনো লাইফ-থ্রেটেনিং ইমার্জেন্সির সময় সবচেয়ে কাছের হাসপাতালেই যাওয়া উচিত- কিন্তু সেই হাসপাতালটি যেন কার্ডিয়াক ইমার্জেন্সি ব্যবস্থাসম্পন্ন হয়, সেটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। অনেক হাসপাতালে ইসিজি মেশিন বা ইমার্জেন্সি সেবার অভাব থাকতে পারে, বা হার্ট অ্যাটাক রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিতে পারে, যার ফলে অমূল্য সময় নষ্ট হয়। তাই পরিচিত বা আগেই খোঁজ নেওয়া হাসপাতাল, যেখানে ২৪ ঘণ্টা হার্ট সংক্রান্ত চিকিৎসা, সিসিইউ, ও কার্ডিওলজিস্ট থাকে- তেমন জায়গাই বেছে নেওয়া উচিত।
এছাড়া, হাসপাতাল বাছাইয়ের সময় তাদের রেসপন্স টাইম, রোগী রিসেপশন সাপোর্ট, অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা, এবং চিকিৎসকদের উপস্থিতি বিবেচনায় রাখা দরকার। বড় শহরে যেহেতু অপশন বেশি, তাই পরিবার বা আত্মীয়দের আগে থেকেই ১–২টি হাসপাতালকে “জরুরি চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত” হিসেবে মাথায় রেখে চলা উচিত, যেন ওই সময় বিভ্রান্তি না হয়।
রাস্তায় সময় বাঁচানোর কৌশল
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে রাস্তায় জ্যাম একটি বড় সমস্যা। হার্ট অ্যাটাকের রোগীর জন্য এক্সট্রা ১০ মিনিট মানে হতে পারে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখান। তাই সময় বাঁচানোর জন্য একাধিক রুট আগে থেকে চিন্তা করে রাখা জরুরি- যেখানে ট্রাফিক তুলনামূলক কম থাকে, যেমন উড়ালপথ, সেবা রোড বা সার্ভিস রোড। গুগল ম্যাপের লাইভ ট্রাফিক দেখে তাৎক্ষণিক বিকল্প রুট নির্বাচন করাও কাজে আসতে পারে।
যদি আপনি প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন, তবে গাড়িতে একটি ছোট সাদা তোয়ালে বা রুমাল বাইরের আয়নায় বাঁধা যেতে পারে (এটি জরুরি সংকেত হিসেবে কাজ করে), এবং উচ্চ শব্দে হর্ন ব্যবহার করতে পারেন। তবে এসব কৌশল সবসময় কাজে আসে না- তাই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করাই সেরা, কারণ তা সাইরেন দিয়ে ট্রাফিক ক্লিয়ার করতে পারে। স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশের হেল্পলাইন নম্বরও ফোনে সংরক্ষিত রাখা ভালো, যাতে রাস্তায় সাহায্য চাওয়া যায়।
উপসংহার
একটি হার্ট অ্যাটাক মানে শুধু একজন মানুষের বিপদ না- তার পরিবার, প্রিয়জন, এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো হুমকির মুখে পড়ে যায়। কিন্তু আপনি যদি আগে থেকেই জানেন হার্ট অ্যাটাকের পর করণীয়, তাহলে এই বিপদ থেকে অন্তত কাউকে রক্ষা করতে পারবেন। মনে রাখবেন, একজন সাধারণ মানুষও হতে পারেন একজন হিরো, যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। CPR শেখা, জরুরি নম্বর জানা, এবং হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করাই হতে পারে আপনার সবচেয়ে বড় সামাজিক অবদান। জীবন খুবই মূল্যবান- আর তা বাঁচানো আপনার-আমার দায়িত্ব।