কার্ডিওভাসকুলার রোগ কি, কেন এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতিই-বা কি?

কার্ডিওভাসকুলার রোগ

প্রতিদিন সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ বুকে ব্যথা অনুভব করে, কেউ বা শ্বাসকষ্টে ভুগে, আবার কেউ চরম অবসাদে ভেঙে পড়ে। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারে না- এই সামান্য লক্ষণগুলোর পেছনেই লুকিয়ে থাকতে পারে এক নীরব ঘাতক। হ্যাঁ, বলছিলাম কার্ডিওভাসকুলার রোগ এর কথা। কার্ডিওভাসকুলার রোগ (CVD) হলো হৃদযন্ত্র ও রক্তনালির জটিল সমস্যা, যা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য মারাত্মক অসুস্থতারও কারণ হতে পারে।

 বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ এই রোগে প্রাণ হারায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২%। আধুনিক জীবনযাত্রার অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং মানসিক চাপ এই রোগকে মহামারির আকার দিয়েছে। তাই কার্ডিওভাসকুলার রোগ বর্তমানে কেবল একটি স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নয় বরং এটি একটি বৈশ্বিক সংকটও বটে।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ কি?

কার্ডিওভাসকুলার রোগ (Cardiovascular Disease – CVD) বলতে মূলত হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ বোঝায়। বিশ্বব্যাপী এটি মৃত্যু ও অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ। কার্ডিওভাসকুলার রোগের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction), স্ট্রোক (Stroke), উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা (Hypertension), হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতার ঘাটতি (Heart Failure) এবং ধমনী সংকীর্ণতা (Atherosclerosis) উল্লেখযোগ্য। সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি, ধূমপান, মদ্যপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এসব রোগের মূল কারণ। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং মানসিক চাপের কারণে রক্তনালীগুলো সরু হয়ে যেতে পারে, যা রক্ত সঞ্চালনে বাধার সৃষ্টি করে। ধমনীতে জমে থাকা চর্বি রক্তপ্রবাহ বন্ধ করে দিলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রধান প্রকারভেদ

করোনারি হার্ট ডিজিজ (Coronary Heart Disease)

করোনারি হার্ট ডিজিজ (CHD) হলো একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর হৃদরোগ, যা তখন ঘটে যখন হার্টের প্রধান ধমনী (করোনারি আর্টারি) সংকীর্ণ বা ব্লক হয়ে যায়। এই সমস্যার মূল কারণ হলো অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস, যেখানে ধমনীতে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য উপাদানের জমা হয়ে প্লাক তৈরি হয়। ধমনী সংকীর্ণ হয়ে গেলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে হৃদযন্ত্র পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এটি অ্যাংজাইনা (বুকে ব্যথা), হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মতো প্রাণঘাতী অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই রোগের জন্য প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।

CHD প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, মানসিক চাপ কমানো এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। চিকিৎসার জন্য ওষুধ, লাইফস্টাইল পরিবর্তন এবং কিছু ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। দ্রুত শনাক্তকরণ এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে এই রোগ প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই হঠাৎ বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

স্ট্রোক (Stroke)

স্ট্রোক একটি মারাত্মক কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, যা তখন ঘটে যখন মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয় বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে। সাধারণত এটি দুই প্রকারের হতে পারে—ইসকেমিক স্ট্রোক, যেখানে রক্তনালী ব্লক হয়ে যায় এবং হেমোরেজিক স্ট্রোক, যেখানে রক্তনালী ফেটে যায়। ইসকেমিক স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি ঘটে এবং এটি সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল জমে যাওয়া বা রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হয়। অন্যদিকে, উচ্চ রক্তচাপ বা আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়।

স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে মস্তিষ্কের কোষগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলে পক্ষাঘাত, কথা বলায় সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপান পরিহার করা জরুরি। স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে মুখের একপাশ ঝুলে পড়া, হাত বা পা দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং কথা বলার অসুবিধা অন্তর্ভুক্ত। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন, কারণ যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, তত বেশি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure)

হার্ট ফেইলিউর এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং শরীরের প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। এটি সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ডায়াবেটিস, বা পূর্বের হার্ট অ্যাটাকের ফলে ঘটে। হার্ট ফেইলিউরের ফলে শরীরে রক্ত ও তরল জমতে পারে, যার ফলে ফুসফুসে তরল জমে শ্বাসকষ্ট, পায়ের ফোলা, ক্লান্তি এবং দুর্বলতা দেখা যায়। এটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগীর জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।

এই রোগের চিকিৎসায় ওষুধ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং জীবনধারার পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিছু ক্ষেত্রে, রোগীদের জন্য পেসমেকার বা হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের মতো জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। যেহেতু হার্ট ফেইলিউর সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তাই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন এবং মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তনালীর ভেতরে রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এটি দীর্ঘ সময় ধরে অবহেলা করলে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি সমস্যা ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত দুই ধরনের হয়—প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি। প্রাইমারি হাইপারটেনশনের নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকে না, তবে এটি বয়স, খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা ও পারিবারিক ইতিহাসের কারণে হতে পারে। অন্যদিকে, সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন কিডনি রোগ, হরমোনজনিত সমস্যা বা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে হয়ে থাকে।

এই রোগকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি কোনো উপসর্গ ছাড়াই ধীরে ধীরে শরীরে ক্ষতি করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য লবণ গ্রহণ কমানো, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ওজন নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। কিছু রোগীর জন্য নিয়মিত ওষুধ গ্রহণও জরুরি হতে পারে। রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।

কার্ডিওভাসকুলার রোগের কারণসমূহ

অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস

খাদ্যাভ্যাস কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট, ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড ও অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় গ্রহণ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ধমনীর গায়ে চর্বি জমাতে সাহায্য করে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের (ধমনীর সংকোচন) ঝুঁকি বাড়ায় এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। তাছাড়া, অসম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা দেয়, যা হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতাকে দুর্বল করতে পারে।

অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার গ্রহণ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়েট ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যা হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যেমন সবুজ শাকসবজি, আঁশযুক্ত খাবার, স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও উপকারী ফ্যাট গ্রহণ, হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। পরিমিত লবণ ও চিনি গ্রহণ এবং পানি পান বৃদ্ধি করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়, যা কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।

ধূমপান ও মদ্যপানের প্রভাব

ধূমপান কার্ডিওভাসকুলার রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে এবং কার্বন মনোক্সাইড রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ফলে হৃদপিণ্ড স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধূমপান করলে ধমনীর দেয়ালে চর্বি জমতে শুরু করে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, বিশেষ করে যদি তারা দীর্ঘ সময় ধরে ধূমপান করে আসছেন।

অপরদিকে, অতিরিক্ত মদ্যপান লিভার ও কিডনির পাশাপাশি হৃদপিণ্ডের জন্যও ক্ষতিকর। অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং আর্থ্রিথমিয়া (হার্টবিটের অনিয়মিততা) সৃষ্টি করতে পারে। এটি হৃদযন্ত্রের পেশিকে দুর্বল করে তোলে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। অ্যালকোহলের অতিরিক্ত গ্রহণ কার্ডিওমায়োপ্যাথি নামক এক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে, যা হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। তাই ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ

মানসিক চাপ হৃদযন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপের ফলে কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ ঘটে, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগলে তা ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা হার্টের সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর।

চাপযুক্ত জীবনযাপন ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়, যা কার্ডিওভাসকুলার রোগের অন্যতম কারণ। মানসিক চাপ হ্রাসে মেডিটেশন, শারীরিক অনুশীলন, পর্যাপ্ত ঘুম ও ইতিবাচক সামাজিক সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

শারীরিক অনুশীলনের অভাব

শারীরিক অনুশীলন হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় রাখে এবং রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না, তাদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমতে থাকে এবং রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের অসুস্থতার কারণ হয়। শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা ডায়াবেটিস এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের অন্যতম কারণ।

একটি সুস্থ হৃদযন্ত্র বজায় রাখার জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম করা প্রয়োজন। হাঁটাহাঁটি, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা কিংবা দৌড়ানো হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

বংশগত ও জেনেটিক কারণ

অনেক ক্ষেত্রে কার্ডিওভাসকুলার রোগের কারণ বংশগত বা জেনেটিক হয়ে থাকে। পরিবারের কারো যদি পূর্বে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তিরও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। এটি মূলত জিনের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে যায়।

তবে, বংশগত হৃদরোগ থাকলেও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ব্যায়াম, পরিমিত লবণ ও চিনি গ্রহণ, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সুস্থ খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। জেনেটিক কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও জীবনযাপন পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ।

লক্ষণ ও সতর্কতা সংকেত

বুকের ব্যথা ও অস্বস্তি

বুকের ব্যথা ও অস্বস্তি সাধারণত হৃদরোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক বা এনজাইনার ইঙ্গিত দিতে পারে। বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা চাপ, জ্বালাপোড়া বা সংকোচনের মতো মনে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যথাটি বাহু, পিঠ, ঘাড়, চোয়াল বা পেটে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হৃদযন্ত্রের সমস্যা ছাড়াও অ্যাসিডিটি, গ্যাস্ট্রিক বা ফুসফুসজনিত কারণেও বুকের ব্যথা হতে পারে, তবে যে কোনো অস্বাভাবিক ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

বুকের ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া, বমি বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরা দেখা দিলে এটি আরও গুরুতর সংকেত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল বা অতিরিক্ত মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং ধূমপান বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা উচিত। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে হৃদরোগজনিত জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

শ্বাসকষ্ট ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন

শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, তবে এটি হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা এবং রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতির ইঙ্গিত দিতে পারে। হৃদযন্ত্র যদি পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে না পারে, তাহলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়, যার ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এটি হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় বেশি অনুভূত হয় এবং বিশ্রামের সময় কমতে পারে। হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

অন্যদিকে, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (অ্যারিথমিয়া) হৃদযন্ত্রের ছন্দের ব্যাঘাতকে বোঝায়, যেখানে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত, ধীর বা অনিয়মিত হতে পারে। এই সমস্যা হলে হঠাৎ বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ক্যাফেইন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা বা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী হলে এটি হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণ হতে পারে, তাই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হাত-পা অবশ বা দুর্বলতা

হাত-পা অবশ বা দুর্বল হয়ে যাওয়া সাধারণত স্নায়ুজনিত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়, তবে এটি স্ট্রোকের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণও হতে পারে। যদি হঠাৎ করে শরীরের একপাশের হাত, পা বা মুখের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায় বা নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়, তবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। স্ট্রোক হলে ব্রেনের নির্দিষ্ট অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে শরীরের কিছু অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন এবং ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

তবে কিছু ক্ষেত্রে পেশির দুর্বলতা বা অবশভাব ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতি, দীর্ঘসময় একভাবে বসে থাকা বা স্নায়ুর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণেও হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে স্নায়ু ও পেশির স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব। যদি হাত-পা বারবার অবশ হয়ে যায়, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি ও মাথা ঘোরা

দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ শরীরের বিভিন্ন সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হলো রক্তস্বল্পতা, থাইরয়েডের সমস্যা এবং হৃদরোগ। যদি প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে গিয়েও অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হয়, তাহলে তা রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি বা পুষ্টির অভাবের কারণে হতে পারে। অনিদ্রা, মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত ওজনও দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির কারণ হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা জরুরি।

মাথা ঘোরা সাধারণত রক্তচাপের ওঠানামার সঙ্গে সম্পর্কিত। রক্তচাপ কমে গেলে ব্রেনে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত না হওয়ার ফলে মাথা ঘুরতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়া ডিহাইড্রেশন, শর্করার মাত্রার পরিবর্তন বা কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে। যদি এটি ঘন ঘন ঘটে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করা প্রয়োজন।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

হৃদরোগ বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যাগুলো সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন অনেক সহজ ও কার্যকর উপায়ে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক উপাদানগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব। নিচে কিছু প্রধান পরীক্ষার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো—

ইসিজি (ECG – Electrocardiogram)

ইসিজি (ECG) হলো হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপের একটি সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এতে হৃদযন্ত্রের ছন্দ (রিদম) এবং স্পন্দনের গতিবিধি বিশ্লেষণ করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে—

  • হার্ট অ্যাটাক বা আগের হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস চিহ্নিত করা যায়।
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (অ্যারিথমিয়া) সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
  • হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেনের সরবরাহে কোনো ঘাটতি হচ্ছে কি না, তা বোঝা যায়।

ইসিজি পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীরে বিশেষ সেন্সর যুক্ত ইলেক্ট্রোড লাগানো হয়, যা হৃদয়ের বৈদ্যুতিক সংকেত সংগ্রহ করে। এই সংকেত থেকে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

ইকোকার্ডিওগ্রাফি (Echocardiography)

ইকোকার্ডিওগ্রাফি বা ‘ইকো’ হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, যা আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে হৃদপিণ্ডের গঠন, কার্যকারিতা ও রক্তপ্রবাহের অবস্থা বিশ্লেষণ করে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে—

  • হৃদপিণ্ডের ভালভ ও চেম্বারগুলোর কার্যক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
  • হার্ট ফেইলিওর, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, বা কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
  • রক্ত প্রবাহে কোনো বাধা বা জমাট বাঁধা রক্তের উপস্থিতি বোঝা যায়।

এই পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ ব্যথাহীন ও নিরাপদ। সাধারণত চিকিৎসকরা যদি হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তবে ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরামর্শ দেন।

ব্লাড টেস্ট ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা

রক্ত পরীক্ষা হৃদরোগ নির্ণয়ের অন্যতম প্রধান উপায়। ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে—

  • হৃদযন্ত্রের সমস্যার অন্যতম কারণ উচ্চ কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা জানা যায়।
  • হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা নির্ধারণের জন্য ট্রোপোনিন (Troponin) টেস্ট করা হয়, যা হৃদপিণ্ডের পেশির ক্ষতি হয়েছে কি না তা চিহ্নিত করে।
  • সিআরপি (CRP – C-reactive protein) টেস্ট করা হয়, যা হৃদপিণ্ডের প্রদাহের পরিমাণ নির্ধারণে সাহায্য করে।
  • ব্লাড সুগার ও ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স পরীক্ষা করা হয়, যা ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বোঝাতে পারে।

নিয়মিত কোলেস্টেরল ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্ক হওয়া সম্ভব।

স্ট্রেস টেস্ট (Stress Test)

স্ট্রেস টেস্টের মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের কর্মক্ষমতা ও রক্ত প্রবাহের অবস্থা পরীক্ষা করা হয়, বিশেষ করে যখন এটি অতিরিক্ত পরিশ্রম বা চাপের মুখোমুখি হয়। এই পরীক্ষায়—

  • রোগীকে ট্রেডমিল বা স্টেশনারি সাইকেলে চালিয়ে হৃদপিণ্ডের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়।
  • পরীক্ষা চলাকালীন ইসিজি, রক্তচাপ এবং অক্সিজেন লেভেল মনিটর করা হয়।
  • যদি কোনো ব্যক্তি শারীরিক পরিশ্রম করতে না পারেন, তবে ওষুধ দিয়ে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করে পরীক্ষাটি পরিচালনা করা হয়।

স্ট্রেস টেস্ট মূলত করোনারি আর্টারি ডিজিজ শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন যে হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছে কি না।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ ও জীবনধারা পরিবর্তন

হৃদরোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা। কার্ডিওভাসকুলার রোগ সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের আধিক্য, স্থূলতা, ধূমপান, ওজন বৃদ্ধি, মানসিক চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে হয়ে থাকে। তবে নিয়মিত স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুললে এই রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ে, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং রক্তনালীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা বজায় থাকে।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত ব্যায়াম করা, মানসিক চাপ কমানো এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করার মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধু শারীরিক সুস্থতার জন্যই নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও এই অভ্যাসগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (Mediterranean Diet, DASH Diet)

সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায়। Mediterranean Diet এবং DASH Diet বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত দুটি ডায়েট, যা হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। Mediterranean Diet-এ প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, অলিভ অয়েল এবং ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এতে প্রক্রিয়াজাত খাবার, লাল মাংস ও অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার সীমিত রাখা হয়, যা ধমনী পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, DASH Diet মূলত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এবং এতে কম লবণযুক্ত খাবার, উচ্চ ফাইবারযুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল এবং কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এই খাদ্যাভ্যাসগুলো অনুসরণ করলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়। ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত মিষ্টি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এগুলো ধমনীতে চর্বি জমিয়ে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধুমাত্র হৃদরোগ প্রতিরোধই করে না, এটি ওজন নিয়ন্ত্রণ, হজম শক্তি বাড়ানো এবং সামগ্রিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নিয়মিত ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম

শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট ব্যায়াম করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, ধমনী নমনীয় থাকে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হাঁটাহাঁটি, দৌড়, সাইক্লিং, সাঁতার, ওজন তোলা ইত্যাদি শারীরিক কার্যকলাপ হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখে। ব্যায়াম ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ।

যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন হৃদরোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে মানসিক চাপ কমে, যা হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন (প্রাণায়াম) রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমায়। মেডিটেশন স্ট্রেস হরমোন কমিয়ে দেয়, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্যস্ত জীবনে কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুললে হৃদরোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।

ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ

ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। সিগারেটের নিকোটিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালী সংকুচিত করে, যা রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত ধূমপান করলে ধমনীতে চর্বি জমে, যা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (ধমনী সংকুচিত হওয়ার রোগ) সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। যারা ধূমপান করেন না, তাদের তুলনায় ধূমপায়ীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেশি।

অ্যালকোহল সেবন হৃদপিণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়ায়, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। এটি হৃদপিণ্ডের পেশিগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস করে, যা হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়। যারা ধূমপান ও অ্যালকোহলের অভ্যাস পরিত্যাগ করেন, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই সুস্থ জীবনযাপনের জন্য ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের উপায়

মানসিক চাপ হৃদরোগের অন্যতম বড় কারণ। অতিরিক্ত মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদযন্ত্রের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি ও ধমনীর সংকোচন ঘটাতে পারে। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মেডিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং ইতিবাচক মনোভাব গঠন করা জরুরি। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, পছন্দের কাজ করা, সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা এবং ধ্যান করা স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে। কাজের চাপে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং বিশ্রামের পর্যাপ্ত সময় নেওয়া হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। তাই সুস্থ হৃদপিণ্ডের জন্য মানসিক চাপ কমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধযোগ্য হলেও, অধিকাংশ মানুষ সতর্ক হয় তখন, যখন অনেক দেরি হয়ে যায়। অথচ সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি সত্ত্বেও, মানুষের অসচেতনতা এবং জীবনধারাগত সমস্যাগুলো কার্ডিওভাসকুলার রোগকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। তাই, সময় থাকতে সাবধান হওয়া এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

আরও পড়ুন।

Related posts

Leave a Comment