হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু

আপনি কি জানেন, প্রতি ৩৩ সেকেন্ডে একজন মানুষ হৃদরোগজনিত কারণে প্রাণ হারায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ১৭.৯ মিলিয়ন মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার মধ্যে অধিকাংশই হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু বা ‘হার্ট অ্যাটাক’ এর শিকার। প্রতিদিন, বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের হৃদপিণ্ডের জন্য একটি নীরব যুদ্ধ লড়ছে। এই রোগটি এতটাই নীরব ঘাতক যে, রোগী বুঝতে পারার আগেই তার জীবনের চাকা থেমে যেতে পারে। ‘গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ স্টাডি’ এর তথ্য অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ২৩.৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? কেন আমাদের হৃদপিণ্ড এই মারণব্যাধির সামনে এতটা অসহায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যুর কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। তাই খুবই মনযোগ দিয়ে আমাদের আজকের আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন। 

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু বলতে কি বোঝায়? 

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু বলতে এমন এক পরিস্থিতিকে বোঝানো হয়, যখন হৃদপিণ্ডের পেশী যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত এবং অক্সিজেন পায় না, যার ফলে হৃৎপেশীর কোষগুলো মারা যায়। আমাদের হৃদপিণ্ড প্রতিনিয়ত রক্ত পাম্প করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু যখন কোনো কারণে হৃদপিণ্ডের নিজস্ব রক্তনালী (করোনারি আর্টারি) সংকুচিত হয়ে যায় বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তখন হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত পায় না। এর ফলে হৃদপিণ্ডের পেশী কোষগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে শুরু করে। এই অবস্থাকেই বলা হয় ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’ বা সাধারণ ভাষায় ‘হার্ট অ্যাটাক’।

প্রাথমিকভাবে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমে গেলে বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা, বাম বাহু, কাঁধ, পিঠ বা গলায় ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় এই ব্যথা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, রোগী তা গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির ব্যথা বলে ভুল করতে পারেন। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড ঘাম, বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরা উল্লেখযোগ্য। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তবে হৃৎপেশীর কোষগুলো স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা পরবর্তীতে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।

মেডিকেলের দৃষ্টিকোণ থেকে

মেডিকেলের ভাষায়, হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু বা ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন’ একটি গুরুতর কার্ডিওভাসকুলার অবস্থা যেখানে করোনারি আর্টারিতে প্লাক (চর্বি, কোলেস্টেরল ও অন্যান্য উপাদান) জমা হয়ে সরু হয়ে যায়, অথবা রক্ত জমাট বেঁধে করোনারি আর্টারি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। যখন করোনারি আর্টারির মধ্যে রক্ত প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন হৃদপিণ্ডের পেশীগুলো অক্সিজেনের অভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোষ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। এই অবস্থা যদি ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়, তবে তা স্থায়ী ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের সময় সাধারণত ‘ট্রপোনিন’ নামক একধরনের প্রোটিনের মাত্রা রক্তে বেড়ে যায়, যা হৃদপেশীর ক্ষতির নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। ইসিজি (ECG) এবং ইকোকার্ডিওগ্রাফির মতো পরীক্ষা দিয়ে হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসা হিসেবে ‘থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি’, এনজিওপ্লাস্টি, অথবা ‘করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি’র মতো প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়, যা আক্রান্ত রক্তনালী পুনরায় খুলে দেয়ার মাধ্যমে রক্ত প্রবাহ পুনরায় স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। তাছাড়া, রোগীর অবস্থা অনুসারে ‘অ্যান্টি-কোয়াগুল্যান্ট’, ‘অ্যান্টি-প্লেটলেট’ ওষুধ এবং জীবনধারায় পরিবর্তন করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে হৃদপিণ্ডের পেশীগুলো স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা পরবর্তীতে হার্ট ফেইলিওর বা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং, হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম।

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু এর সাধারণ কিছু কারণ

এবার চলুন এমন কিছু সাধারণ কারণ সম্পর্কে জেনে আসা যাক, যেগুলোকে হৃদপেশির রক্তাভাবজনিত মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

১. অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis)

অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হলো হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যুর সবচেয়ে সাধারণ কারণ। এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে হৃদপিণ্ডের করোনারি আর্টারির দেওয়ালে চর্বি, কোলেস্টেরল, এবং অন্যান্য পদার্থ জমা হয়ে প্লাক তৈরি করে। এই প্লাকগুলি ধীরে ধীরে রক্তনালীগুলোর ভেতরের অংশ সংকুচিত করে এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। এক পর্যায়ে, প্লাক ফেটে যেতে পারে, যার ফলে রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হয় এবং রক্তনালী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। যখন রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না, তখন হৃদপেশী অক্সিজেনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যায়। অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস সাধারণত উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, এবং ডায়াবেটিসের কারণে হয়। তাই, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

২. রক্ত জমাট বাঁধা (Blood Clots)

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যুর আরেকটি প্রধান কারণ হলো রক্ত জমাট বাঁধা বা ‘থ্রম্বোসিস’। অনেক সময়, করোনারি আর্টারির প্লাক ফেটে গেলে রক্তের প্লেটলেটগুলি ঐ স্থানে জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং একটি বড় রক্তের গাঁট তৈরি করে। এই গাঁট পুরোপুরি রক্তনালী বন্ধ করে দিলে রক্ত এবং অক্সিজেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা হার্ট অ্যাটাক সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। রক্ত পাতলা করার জন্য চিকিৎসকরা প্রায়ই ‘অ্যান্টি-কোয়াগুল্যান্ট’ ওষুধ বা ‘অ্যান্টি-প্লেটলেট’ ওষুধ দিয়ে থাকেন, যা রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

৩. করোনারি আর্টারির স্প্যাজম (Coronary Artery Spasm)

করোনারি আর্টারির আকস্মিক সংকোচন বা ‘স্প্যাজম’ একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যেখানে হৃদপিণ্ডের প্রধান রক্তনালীগুলো হঠাৎ সংকুচিত হয়ে যায়। এর ফলে রক্ত প্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়ে হৃদপেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণত মাদকদ্রব্য (যেমন: কোকেন), অ্যালকোহল বা তীব্র মানসিক চাপের কারণে এই ধরনের সংকোচন হতে পারে। এমনকি রাতে ঘুমের সময়ও এই স্প্যাজম হতে পারে, যা রোগীকে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকের মুখোমুখি করতে পারে। নিয়মিত মেডিটেশন এবং চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ ধরনের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

৪. হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন দীর্ঘ সময় ধরে হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। হৃদপিণ্ডকে বেশি পরিমাণ রক্ত পাম্প করতে হয়, যার ফলে করোনারি আর্টারিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ রক্তচাপের কারণে আর্টারির প্রাচীর শক্ত হয়ে যায় এবং প্লাক জমার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা পরবর্তীতে হৃৎপেশীর রক্তাভাব সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। তাই, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।

৫. ডায়াবেটিস (Diabetes)

ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই রোগটি রক্তের শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা করোনারি আর্টারিগুলোর ক্ষতি করতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয় এবং প্লাক জমার প্রবণতা বেড়ে যায়, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। এছাড়া, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ‘ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি’র কারণে হৃদরোগের লক্ষণগুলো (যেমন বুকের ব্যথা) কম স্পষ্ট থাকে, ফলে তারা প্রায়ই দেরিতে চিকিৎসা নেন। নিয়মিত রক্তের শর্করা পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় জীবনধারার পরিবর্তন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।

আরো কারন জানতে আমাদের এই আর্টিকেল টি পড়ে আরো জানতে পারেন। হার্ট অ্যাটাক কেন হয় সে সম্পর্কে সুন্দর ধারনা দেয়া আছে।

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু হতে বাঁচতে যা করবেন

জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের ছন্দ, প্রতিটি শ্বাস আমাদের হৃদপিণ্ডের সুস্থতার উপর নির্ভরশীল। অথচ আমরা প্রায়ই এই মূল্যবান অঙ্গটির যত্ন নিতে ভুলে যাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার মধ্যে অধিকাংশের কারণ হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু। এরকম মৃত্যুর হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমরা প্রায়ই তা বুঝতে পারি না যতক্ষণ না আমরা বা আমাদের প্রিয়জনেরা এই ঝুঁকির সম্মুখীন হই। কিন্তু চিন্তা করবেন না! সঠিক জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যসচেতনতার মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে পারি। তাই, আসুন জেনে নিই এমন কিছু কার্যকর উপায় যা আপনার হৃদপিণ্ডকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে-

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন

আপনার হৃদয় সুস্থ রাখতে হলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। উচ্চমাত্রার চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার যেমন: ভাজা-পোড়া, ফাস্ট ফুড, এবং প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলুন। এর পরিবর্তে, বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ (যেমন: স্যামন, ম্যাকরেল), বাদাম, এবং হোলগ্রেইন শস্য বেছে নিন। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার থাকে, যা কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং রক্তনালীগুলোর স্বাস্থ্য উন্নত করে। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিকেশনের মতে, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ফলমূল এবং সবজি অন্তর্ভুক্ত করলে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ৩০% পর্যন্ত কমে যায়।

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন

হৃদয়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। WHO এর পরামর্শ অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতা সম্পন্ন অ্যারোবিক ব্যায়াম (যেমন: হাঁটা, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা) করতে হবে। শারীরিক ব্যায়াম রক্তচাপ কমায়, খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়, এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫-৩০% কমে যায়। তাই দৈনন্দিন জীবনে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।

ধূমপান এবং অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ধূমপান সরাসরি রক্তনালীগুলোর প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে, যা করোনারি আর্টারি বন্ধ করে দিতে পারে। একইভাবে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল হৃদপিণ্ডের পেশীগুলো দুর্বল করে এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান হৃদরোগের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে দেয়। তাই হৃদয়ের সুরক্ষায় ধূমপান এবং অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে বর্জন করুন।

নিয়মিত রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করুন

আপনার রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল লেভেল নিয়মিত পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল প্রায়ই নিরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে, কারণ এগুলোর লক্ষণ প্রায়শই অদৃশ্য থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিণ্ডের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে আপনি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপডেট থাকতে পারবেন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবেন।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। স্থূলতা সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের সাথে সম্পর্কিত, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৫-১০% ওজন কমালে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই, সুস্থ ওজন বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন।

মানসিক চাপ কমানোর কৌশল শিখুন

মানসিক চাপ হৃদয়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে শরীরে ‘কোর্টিসল’ এবং ‘অ্যাড্রিনালিন’ হরমোনের উৎপাদন বাড়ে, যা রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, অথবা ডিপ ব্রিদিং এর মতো রিল্যাক্সেশন টেকনিক শিখুন। নিয়মিত মানসিক প্রশান্তি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।

পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন

ঘুমের অভাব হৃদরোগের জন্য একটি অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি হতে পারে। প্রতিরাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম হৃদয়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমায়, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ৪৮% বেশি। পর্যাপ্ত ঘুম রক্তচাপ এবং ইনফ্লেমেশন কমায়, যা হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে। তাই প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার এবং ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন।

সোডিয়াম এবং চিনি গ্রহণ কমান

অতিরিক্ত লবণ এবং চিনি হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বেশি পরিমাণে সোডিয়াম গ্রহণ রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। একইভাবে, অতিরিক্ত চিনি ওজন বৃদ্ধি এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রক্রিয়াজাত খাবার, মিষ্টি পানীয় এবং অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলুন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন

ডায়াবেটিস হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে ক্ষতি করতে পারে, যা রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই আপনার রক্তের শর্করা নিয়মিত পরীক্ষা করুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

পর্যাপ্ত পানি পান করুন

হৃদপিণ্ডের কার্যক্রম সচল রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি রক্তের ঘনত্ব কমায় এবং রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখে। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন, বিশেষত গরম আবহাওয়ায় বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় আরও বেশি পানি পান করা উচিত। পর্যাপ্ত পানি পানের ফলে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।

হৃৎপিণ্ডের অকৃতকার্যতার ইতি কথা

হৃৎপেশীর রক্তাভাবজনিত মৃত্যু যে কোনো সময় যে কাউকে আঘাত করতে পারে অফিসের ডেস্কে বসা একজন কর্মী, রাস্তায় হাঁটতে থাকা একজন পথচারী, কিংবা খেলাধুলায় ব্যস্ত একজন তরুণ অ্যাথলেট। এই রোগের নীরব ঘাতক স্বভাব, সচেতনতার অভাব এবং আধুনিক জীবনযাত্রার অবনতি একে আরও ভয়ানক করে তুলেছে। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই মারাত্মক রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা, মানসিক চাপ কমানো এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা হৃদরোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়।

প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে, আজকাল ‘ডিজিটাল হার্ট মনিটর’ এবং ‘স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন’ এর মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের সুস্থতা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তাই, এখন সময় এসেছে নিজের হৃদয়ের যত্ন নেয়ার। মনে রাখবেন, আপনার হৃদয় শুধু একটি অঙ্গ নয়; এটি আপনার জীবনের স্পন্দন। তাই, হৃদয়ের প্রতি সঠিক যত্ন নেয়া আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য।

আপনার জীবনের গল্পকে একটি ‘কমা’ বা ‘হাইফেন’ দিয়ে থামিয়ে দেবেন না; বরং, আপনার হার্টের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন, এবং জীবনকে আরও দীর্ঘ এবং সুন্দর করে তুলুন। কারণ, মনে রাখবেন হৃদয় থেমে গেলে, জীবনও থেমে যায়।

Related posts

Leave a Comment