হার্টের কি কি রোগ হয় এবং কোন রোগ কেন হয়?

আপনি কি জানতেন, প্রতিদিন পৃথিবীতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়! কি অবাক হচ্ছেন। এটা আমার কথা নয়! আমেরিকার একটি পরিসংখ্যান থেকে হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে এমনই চমকে দেয়া একটি  তথ্য উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির পরও হৃদরোগ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ মানুষ হার্টের বিভিন্ন রোগে প্রাণ হারায়। অথচ এই ভয়ংকর পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমরা অনেকেই সচেতন নই। হার্টের কি কি রোগ হয়- এই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞ্যান রাখা আমাদের সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজ নয়তো কাল, হার্টের কোনো না কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের অনেকেরই রয়েছে।

তাই আমাদের আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো, হার্ট এর কি কি রোগ হয় এবং কিভাবে এসব প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও কোন লক্ষণ দেখা দিলে কিভাবে বুঝবেন এটি হার্ট এর কোন রোগের কারণে হয়ছে কিনা- সে সম্পর্কেও আপনাদের কিছুটা আইডিয়া দেয়ার চেষ্টা করবো। তাই অনুরোধ থাকবে, শেষ পর্যন্ত মন দিয়ে পড়ার। 

হার্ট এর রোগ সম্পর্কে কিছু পরিসংখ্যান ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা

বিশ্বব্যাপী হৃদরোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এ রোগের কারণে প্রাণ হারায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে, যা বৈশ্বিক মৃত্যুর প্রায় ৩১%। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে হৃদরোগের প্রকোপ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব। বাংলাদেশেও হৃদরোগ এক মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৩০-৩৫% হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং অন্যান্য হৃদরোগজনিত কারণে ঘটে। শহরাঞ্চলে এ রোগের হার তুলনামূলক বেশি হলেও গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, বেশি পরিমাণে লবণ ও চর্বি গ্রহণ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থূলতা—এসবই হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া, কর্মব্যস্ত জীবনযাপন ও প্রযুক্তিনির্ভরতার ফলে অনেকেই শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলছেন, যা ধীরে ধীরে হার্টের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সচেতনতা বৃদ্ধিই হৃদরোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। সচেতনতার অভাবে অনেক মানুষই তাদের হার্টের সমস্যার শুরুতে উপসর্গগুলোকে অবহেলা করেন এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব করেন, যা প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে আনতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন হৃদরোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ মিনিট নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম ও কম চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এগুলো হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। সামাজিক ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারাভিযানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হার্টের রোগ সম্পর্কে সচেতন করা উচিত, যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও পরিবারে স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, যাতে সবাই স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। সরকার ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার উচিত হৃদরোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা, যেমন বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, হার্ট চেকআপ ক্যাম্প এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করা। সামগ্রিকভাবে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতাই পারে হৃদরোগজনিত অকালমৃত্যু হ্রাস করতে এবং একটি সুস্থ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে।

হার্ট এর কি কি রোগ হয়?

আমাদের আর্টিকেলের এ পর্যায়ে চলুন কিছু গুরুতর হার্ট এর রোগ সম্পর্কে জেনে আসি। 

করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD)

করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary Artery Disease বা CAD) হলো হৃদযন্ত্রের অন্যতম গুরুতর ও সাধারণ সমস্যা, যা হার্টের রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বা করোনারি ধমনীগুলোর সংকোচন ও ব্লকেজের ফলে সৃষ্টি হয়। এই ধমনীতে ধীরে ধীরে কোলেস্টেরল, চর্বি, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য পদার্থ জমে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis) নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়া ঘটায়, যা ধমনীর স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। রক্ত প্রবাহ কমে গেলে হার্ট পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, ফলে এনজাইনা (বুকের ব্যথা), হার্ট অ্যাটাক এবং দীর্ঘমেয়াদে হার্ট ফেইলিওরের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এই রোগ নীরবে শুরু হলেও ধীরে ধীরে প্রাণঘাতী পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

করোনারি আর্টারি ডিজিজের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর

CAD মূলত দীর্ঘমেয়াদী ও ক্রমবর্ধমান একটি রোগ, যা বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণে তৈরি হয়। কিছু সাধারণ কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো:

  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত চর্বি ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, প্রসেসড ফুড, বেশি লবণ ও চিনি গ্রহণ ধমনীর ব্লকেজ সৃষ্টি করে।
  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ ধমনীর প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং CAD-এর ঝুঁকি বাড়ায়।
  • উচ্চ কোলেস্টেরল: রক্তে এলডিএল (LDL বা খারাপ কোলেস্টেরল) বেশি থাকলে করোনারি ধমনীগুলোতে প্লাক জমতে পারে, যা রক্ত প্রবাহ ব্যাহত করে।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল: নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড ধমনীগুলোকে সংকুচিত করে এবং রক্তে ক্ষতিকর প্লাক তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
  • ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হার্টের ধমনীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয় এবং CAD-এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
  • মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শরীরে স্ট্রেস হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং ধমনীর সংকোচন ঘটায়।
  • শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ও স্থূলতা: নিয়মিত ব্যায়াম না করা এবং অতিরিক্ত ওজন CAD-এর অন্যতম প্রধান কারণ।

করোনারি আর্টারি ডিজিজের লক্ষণ

CAD প্রাথমিক অবস্থায় স্পষ্ট কোনো উপসর্গ সৃষ্টি নাও করতে পারে, তবে যখন ধমনীর ব্লকেজ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

  • এনজাইনা (Angina): এটি CAD-এর সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ, যা বুকের মাঝখানে বা বাম দিকে ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে। এই ব্যথা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম বা মানসিক চাপের সময় বৃদ্ধি পায় এবং বিশ্রামে কমে যায়।
  • শ্বাসকষ্ট: পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাবে হার্ট দুর্বল হয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে, বিশেষত শারীরিক পরিশ্রমের সময়।
  • অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন: হার্টবিট অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে, যা কখনো ধীরে বা কখনো দ্রুত হতে পারে।
  • বুকের চাপ ও জ্বালাপোড়া: অনেক রোগী বুকের চাপ অনুভব করেন, যা কিছুক্ষণের জন্য স্থায়ী হয় বা দীর্ঘমেয়াদে বাড়তে পারে।
  • হার্ট অ্যাটাক: যদি কোনও ধমনীর ব্লকেজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তবে হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction) হতে পারে, যা জীবনঘাতী হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকের তীব্র ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব, ঘাম এবং মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে।

করোনারি আর্টারি ডিজিজ নির্ণয় ও পরীক্ষা

CAD নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা পরীক্ষা করা হয়, যা রোগের অবস্থান ও মাত্রা নির্ধারণে সহায়তা করে।

  1. ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG): হার্টবিট ও বিদ্যুৎ প্রবাহ বিশ্লেষণ করে CAD-এর উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়।
  2. ইকোকার্ডিওগ্রাম: এটি হার্টের আল্ট্রাসাউন্ড, যা হৃদযন্ত্রের গঠন ও কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।
  3. স্ট্রেস টেস্ট: হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় হার্টের কার্যক্রম পরীক্ষা করা হয়, যা CAD শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  4. করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি: ধমনীর মধ্যে ডাই ইনজেক্ট করে এক্স-রে দ্বারা ব্লকেজের অবস্থান নির্ণয় করা হয়।
  5. সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি: উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে হৃদযন্ত্রের ধমনীগুলোর বিস্তারিত চিত্র তৈরি করা হয়।

করোনারি আর্টারি ডিজিজের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

CAD-এর চিকিৎসা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা হয়, যা জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ প্রয়োগ এবং অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত করে।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন:

  • সুষম ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ
  • নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার
  • মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন ও পর্যাপ্ত ঘুম

ওষুধ প্রয়োগ:

  • অ্যান্টি-প্লেটলেট ওষুধ যেমন অ্যাসপিরিন রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে সহায়ক
  • স্ট্যাটিনস (Statins) খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে
  • বিটা-ব্লকার ও ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার হার্টের কার্যকারিতা উন্নত করে
  • উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ

সার্জারি ও উন্নত চিকিৎসা:

  • অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি (Angioplasty): ব্লকেজ সরিয়ে ধমনীর প্রবাহ স্বাভাবিক করতে স্টেন্ট বসানো হয়।
  • করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং (CABG): ব্লকেজ বাইপাস করে নতুন রক্ত প্রবাহের পথ তৈরি করা হয়।

 হার্ট ফেইলিউর

হার্ট ফেইলিউর (Heart Failure) হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োজনীয় রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। এটি কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া অবস্থা নয়, বরং এটি দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে নিয়ে যায়। হার্ট ফেইলিউর সাধারণত দুটি ধরণের হতে পারে:

  • সিস্টোলিক হার্ট ফেইলিউর: যখন হৃদপিণ্ডের পাম্পিং ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত করতে পারে না।
  • ডায়াস্টোলিক হার্ট ফেইলিউর: যখন হৃদপিণ্ড শক্ত হয়ে যায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত গ্রহণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।

এটি সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা গেলেও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) এবং স্থূলতা থাকলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সেও এ রোগ দেখা দিতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে হার্ট ফেইলিউর জীবনঘাতী হতে পারে।

হার্ট ফেইলিউরের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর

হার্ট ফেইলিউর সাধারণত অন্যান্য হৃদরোগ বা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার ফলস্বরূপ ঘটে। কিছু প্রধান কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হার্টের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
  • করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD): হার্টের ধমনীগুলো সংকুচিত হয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে হার্টের পেশীগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়।
  • হার্ট অ্যাটাক: হার্ট অ্যাটাকের ফলে হার্টের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাম্পিং ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা ধীরে ধীরে হার্ট ফেইলিউর সৃষ্টি করতে পারে।
  • কার্ডিওমায়োপ্যাথি: এটি হার্টের পেশীর একটি দুর্বলতা বা ব্যাধি, যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন জেনেটিক সমস্যা, ভাইরাল সংক্রমণ, বা মদ্যপান।
  • ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রক্তনালী এবং হার্টের পেশীগুলোর ক্ষতি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট ফেইলিউর তৈরি করতে পারে।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল: ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ হার্টের কার্যকারিতা দুর্বল করে দেয়।
  • কিডনি রোগ: কিডনি ও হৃদপিণ্ড পরস্পর সম্পর্কিত। কিডনির সমস্যা হলে শরীরে অতিরিক্ত তরল জমতে পারে, যা হার্টের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
  • স্থূলতা ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: অতিরিক্ত ওজন হার্টের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্তচলাচল বিঘ্নিত করে।

হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণ

হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হতে পারে। সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়:

  • শ্বাসকষ্ট (Dyspnea): এটি হার্ট ফেইলিউরের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা শোয়ার পর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা: শরীরের বিভিন্ন অংশে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ না হওয়ায় রোগী সবসময় দুর্বল অনুভব করতে পারেন।
  • পায়ে, গোড়ালি ও পেটের অংশে ফোলা (Edema): হার্ট রক্ত সঞ্চালন ঠিকভাবে করতে না পারলে শরীরে পানি জমে যায়, বিশেষত পা ও গোড়ালিতে ফোলাভাব দেখা যায়।
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন: হার্টবিট স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত বা ধীর হতে পারে, যা অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
  • বুক ব্যথা: যদিও এটি সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, তবে কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ফেইলিউর থাকলে বুকের চাপ অনুভূত হতে পারে।
  • কফ ও শ্বাসকষ্ট: ফুসফুসে অতিরিক্ত তরল জমে গেলে কাশির সঙ্গে ফেনাযুক্ত বা গোলাপি রঙের কফ আসতে পারে।
  • মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব: এতে রোগীর বিভ্রান্তি, স্মৃতিভ্রংশ, অথবা দুশ্চিন্তা হতে পারে।

হার্ট ফেইলিউর নির্ণয়ের পদ্ধতি

হার্ট ফেইলিউর সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর হার্টের কার্যক্ষমতা মূল্যায়ন করেন।

  • ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG): হার্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ ও অনিয়মিত হার্টবিট নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
  • ইকোকার্ডিওগ্রাম: এটি হার্টের আল্ট্রাসাউন্ড, যা হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।
  • ব্লাড টেস্ট: রক্তে BNP (B-type Natriuretic Peptide) মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, যা হার্ট ফেইলিউরের চিহ্ন নির্দেশ করে।
  • স্ট্রেস টেস্ট: শারীরিক পরিশ্রমের সময় হার্টের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়।
  • এমআরআই ও সিটি স্ক্যান: হার্টের গঠন ও রক্তপ্রবাহ বিশ্লেষণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

হার্ট ফেইলিউর সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য না হলেও, উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: কম চর্বিযুক্ত, কম লবণযুক্ত ও উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা প্রয়োজন।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার: এগুলো হার্টের কার্যক্ষমতা আরও খারাপ করে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন কমানোর মাধ্যমে হার্টের উপর চাপ কমানো সম্ভব।
  • স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: মেডিটেশন ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া উচিত।

ওষুধ চিকিৎসা

  • ডিউরেটিকস: শরীরের অতিরিক্ত তরল ও লবণ বের করে দেয়, যা ফোলা কমাতে সাহায্য করে।
  • বিটা-ব্লকার: এটি হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • এসিই ইনহিবিটর ও এআরবি: এগুলো রক্তনালী প্রসারিত করে রক্তচাপ কমিয়ে দেয়।

অস্ত্রোপচার ও উন্নত চিকিৎসা

  • হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট: গুরুতর অবস্থায় হার্ট প্রতিস্থাপন করা হয়।
  • পেসমেকার: হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখার জন্য এটি বসানো হয়।
  • করোনারি বাইপাস সার্জারি (CABG): ব্লকেজ অপসারণের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়।

আরিথমিয়া

হৃদযন্ত্র একটি নির্দিষ্ট ছন্দে সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহ করে। কিন্তু যখন এই স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয় এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে খুব ধীর (Bradycardia) বা অতিরিক্ত দ্রুত (Tachycardia) হয়ে যায়, তখন তাকে আরিথমিয়া (Arrhythmia) বলা হয়। এটি হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক সংকেতের অস্বাভাবিকতার কারণে ঘটে এবং মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। আরিথমিয়া কখনো হঠাৎ করে অনুভূত হয় এবং কিছু সময়ের জন্য থাকলেও, অনেক সময় এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং চিকিৎসা না করালে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিউরের মতো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

কারণ

আরিথমিয়ার মূল কারণ হলো হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক সংকেতের সুষম কার্যপ্রবাহে ব্যাঘাত। সাধারণত হৃদযন্ত্রের এসএ নোড (Sinoatrial Node) থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত উৎপন্ন হয় এবং এটি হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে যখন এসএ নোডের কার্যকারিতা কমে যায়, অথবা অতিরিক্ত সংকেত প্রেরণ করতে শুরু করে, তখন হৃদস্পন্দনের ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন, মানসিক চাপ, ক্যাফেইন গ্রহণ এবং কিছু ওষুধ আরিথমিয়ার জন্য দায়ী হতে পারে। এমনকি বংশগত কারণেও অনেকে এই সমস্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারেন।

লক্ষণ

আরিথমিয়ার লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি তেমন কোনো উপসর্গ সৃষ্টি করে না, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড় করা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা এবং কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো জটিল অবস্থা তৈরি করতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG), হল্টার মনিটরিং, ইকোকার্ডিওগ্রাম এবং স্ট্রেস টেস্টের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়।

চিকিৎসা পদ্ধতি

চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে আরিথমিয়ার ধরন ও তীব্রতার উপর। কিছু ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে মারাত্মক অবস্থায় চিকিৎসক বিশেষ ধরণের চিকিৎসা যেমন ক্যাথেটার অ্যাব্লেশন (Catheter Ablation), পেসমেকার প্রতিস্থাপন, অথবা কার্ডিওভারশন-ডিফিব্রিলেশন থেরাপি সুপারিশ করতে পারেন। এসব চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক সংকেতের সঠিক প্রবাহ নিশ্চিত করা হয় এবং হৃদস্পন্দনের ছন্দ স্বাভাবিক রাখা হয়।

অরিথিমিয়া প্রতিরোধের উপায়

আরিথমিয়া প্রতিরোধের জন্য সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যাপ্ত ঘুম এই রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস আছে, তাদের অবশ্যই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত, কারণ এসব রোগ হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত ছন্দ সৃষ্টি করতে পারে। সময়মতো আরিথমিয়া শনাক্ত করা গেলে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে মারাত্মক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। সুতরাং, হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জন্মগত হৃদরোগ (Congenital Heart Disease)

জন্মগত হৃদরোগ (Congenital Heart Disease – CHD) হলো এক ধরনের হৃদযন্ত্রের ত্রুটি, যা শিশু জন্মগ্রহণের সময় থেকেই বিদ্যমান থাকে। এটি হৃদপিণ্ডের গঠনগত সমস্যার কারণে ঘটে এবং রক্ত প্রবাহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। কিছু জন্মগত হৃদরোগ তেমন কোনো লক্ষণ সৃষ্টি করে না এবং স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব হয়, তবে কিছু ত্রুটি মারাত্মক হতে পারে এবং জন্মের পরপরই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী নবজাতকদের মধ্যে এটি একটি সাধারণ জন্মগত ত্রুটি এবং চিকিৎসা না করালে অনেক শিশুর জীবন সংকটাপন্ন হতে পারে।

কারণ

জন্মগত হৃদরোগের কারণ সম্পূর্ণরূপে বোঝা না গেলেও গবেষণায় দেখা গেছে, এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার বিভিন্ন কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। গর্ভধারণের সময় যদি মায়ের ভাইরাসজনিত সংক্রমণ হয় (যেমন রুবেলা), যদি মা ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড সমস্যায় ভোগেন, যদি মাদক, অ্যালকোহল, বা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ গ্রহণ করা হয়, তবে শিশুর হৃদযন্ত্রের গঠনে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া, জেনেটিক ত্রুটিও জন্মগত হৃদরোগের একটি বড় কারণ হতে পারে। ডাউন সিনড্রোমসহ বিভিন্ন জিনগত ব্যাধির কারণে শিশুর হৃদপিণ্ডের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

লক্ষণ

জন্মগত হৃদরোগের লক্ষণ শিশুদের বয়স অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। নবজাতকদের ক্ষেত্রে নীলাভ ত্বক (Cyanosis), শ্বাসকষ্ট, ওজন না বাড়া, খাওয়ার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়া এবং বুক ধড়ফড় করা সাধারণ লক্ষণ। বড় বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ক্লান্তি, বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন এবং শারীরিক কার্যক্রমে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যেতে পারে। কিছু জন্মগত হৃদরোগ শিশুদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয়ে ওঠে, আবার কিছু হৃদরোগ তেমন কোনো সমস্যা তৈরি না করেও সারা জীবন থেকে যেতে পারে।

রোগ শনাক্তকরণ

এই রোগ শনাক্ত করার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। নবজাতকদের ক্ষেত্রে পালস অক্সিমেট্রি টেস্টের মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG), বুকের এক্স-রে, এমআরআই এবং ক্যাথেটারাইজেশন পরীক্ষার মাধ্যমে জন্মগত হৃদরোগ শনাক্ত করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসা সহজ হয় এবং শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা

জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা নির্ভর করে ত্রুটির ধরন ও তীব্রতার উপর। কিছু ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, কারণ ত্রুটিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে গুরুতর অবস্থায় ওষুধ প্রয়োগ, ক্যাথেটার-ভিত্তিক পদ্ধতি, ওপেন-হার্ট সার্জারি বা হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসার পরেও অনেক রোগীকে আজীবন কার্ডিওলজিস্টের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়, কারণ ভবিষ্যতে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।

প্রতিরোধ

জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য গর্ভাবস্থায় মায়েদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভধারণের সময় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, সংক্রমণ এড়ানো, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। যেসব দম্পতির পরিবারে জন্মগত হৃদরোগের ইতিহাস আছে, তারা গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বর্তমানে জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা অনেকটাই সফলভাবে করা সম্ভব হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসা ও যত্নের কারণে আক্রান্ত শিশুরা সুস্থভাবে বড় হতে পারছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে। তবে সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণই পারে এই জটিল রোগের ঝুঁকি কমিয়ে শিশুর সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজ

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজ (Hypertensive Heart Disease) হলো উচ্চ রক্তচাপের কারণে সৃষ্ট হৃদরোগের একটি সাধারণ রূপ, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্রের গঠন ও কার্যকারিতায় গুরুতর প্রভাব ফেলে। যখন রক্তচাপ দীর্ঘসময় ধরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তখন হৃদযন্ত্রকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে হৃদপিণ্ডের পেশি ঘন ও শক্ত হয়ে যায়, রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে। এই রোগ যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা হয়, তবে এটি হার্ট ফেইলিউর, হৃদস্পন্দনের অনিয়মিততা (Arrhythmia), করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD) এবং এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজের কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর

এই রোগের মূল কারণ হলো দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension), যা ধমনীতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এই রোগের প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়। স্থূলতা, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, মানসিক চাপ এবং ডায়াবেটিস হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ানোর অন্যতম কারণ।

বংশগত কারণও এই রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদি পরিবারে উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া, কিডনি রোগ বা হরমোনজনিত সমস্যার কারণে অনেকের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

লক্ষণ ও জটিলতা

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজের প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ নাও দেখা যেতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন—

  • বুক ধড়ফড় করা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
  • মাথা ঘোরা ও ক্লান্তি
  • শ্বাসকষ্ট, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের পর
  • বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি
  • পা, গোড়ালি ও পেটে পানি জমা (Edema)
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া এবং ঘুমের সময় শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া

এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার মধ্যে রয়েছে হৃদপিণ্ডের হাইপারট্রফি (Left Ventricular Hypertrophy – LVH), যা হৃদপিণ্ডের দেয়াল পুরু করে তোলে এবং কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি, হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি বিকল হওয়া উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগের অন্যতম মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।

নির্ণয় ও চিকিৎসা

এই রোগ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করতে পারেন, যেমন—

  • রক্তচাপ পরিমাপ: উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার মূল পদ্ধতি
  • ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG): হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক সংকেত পর্যবেক্ষণ করা হয়
  • ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃদপিণ্ডের গঠন ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়
  • এক্স-রে ও এমআরআই: হৃদপিণ্ডের আকার ও রক্তপ্রবাহ মূল্যায়ন করা হয়
  • ব্লাড টেস্ট: কোলেস্টেরল ও কিডনি ফাংশন পরীক্ষা করা হয়

চিকিৎসার জন্য সাধারণত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ দেওয়া হয়, যেমন বিটা-ব্লকার, এঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম ইনহিবিটর (ACE Inhibitors), ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার এবং ডিউরেটিকস।

প্রতিরোধ ও জীবনধারা পরিবর্তন

হাইপারটেনসিভ হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধের জন্য জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো—

  • সঠিক খাদ্যাভ্যাস: লবণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও প্রসেসড ফুড পরিহার করে সবজি, ফল, মাছ এবং কম চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো বা সাইকেল চালানো হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা কমানো প্রয়োজন, কারণ স্থূলতা উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়।
  • মানসিক চাপ কমানো: মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা পর্যাপ্ত বিশ্রামের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন: এগুলো হৃদযন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিত ডাক্তার দেখানো।

কার্ডিওমায়োপ্যাথি: হার্টের পেশির দুর্বলতা

কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardiomyopathy) হলো হৃদপিণ্ডের পেশির রোগ, যা ধীরে ধীরে বা হঠাৎ করে হৃদযন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে। এটি হৃদপিণ্ডের গঠন ও কার্যকারিতায় সমস্যা সৃষ্টি করে, ফলে রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয়। সময়মতো চিকিৎসা না করলে কার্ডিওমায়োপ্যাথি হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতা (Heart Failure), অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia) এবং হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

কার্ডিওমায়োপ্যাথির কারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর

এই রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যার মধ্যে বংশগত কারণ অন্যতম। কারও পরিবারে যদি কার্ডিওমায়োপ্যাথির ইতিহাস থাকে, তবে তার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া, কিছু অর্জিত কারণও কার্ডিওমায়োপ্যাথির জন্য দায়ী হতে পারে, যেমন—

  • উচ্চ রক্তচাপ: দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ রক্তচাপ হৃদযন্ত্রের পেশিকে দুর্বল করে ফেলে।
  • হার্ট অ্যাটাক: আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে হৃদযন্ত্রের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
  • ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ: এসব দীর্ঘস্থায়ী রোগ হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
  • অ্যালকোহল ও মাদকদ্রব্য: অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ বা কোকেনের মতো মাদকের ব্যবহার হৃদযন্ত্রের পেশিকে দুর্বল করে দেয়।
  • ভাইরাল ইনফেকশন: কিছু ভাইরাস হৃদযন্ত্রের পেশিকে সংক্রমিত করে কার্ডিওমায়োপ্যাথির সৃষ্টি করতে পারে।
  • পুষ্টির ঘাটতি: ভিটামিন ও খনিজের অভাব হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
  • অটোইমিউন রোগ: যেমন লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, যা হৃদপেশিকে আক্রান্ত করতে পারে।

কার্ডিওমায়োপ্যাথির ধরন

কার্ডিওমায়োপ্যাথি প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত—

ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Dilated Cardiomyopathy – DCM):

  • সবচেয়ে সাধারণ ধরনের কার্ডিওমায়োপ্যাথি।
  • এতে হৃদযন্ত্রের মূল চেম্বার (ভেন্ট্রিকল) প্রসারিত হয়ে যায়, ফলে রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়।
  • মূলত বংশগত, উচ্চ রক্তচাপ, মদ্যপান এবং ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হয়।
  • এই রোগ হার্ট ফেইলিউরের প্রধান কারণগুলোর একটি।

হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic Cardiomyopathy – HCM):

  • এই রোগে হৃদপিণ্ডের পেশি খুব পুরু হয়ে যায়, ফলে স্বাভাবিকভাবে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়।
  • এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বংশগত এবং তরুণদের আকস্মিক মৃত্যুর একটি কারণ হতে পারে।
  • অনেক সময় তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, কিন্তু বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে।

রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Restrictive Cardiomyopathy – RCM):

  • হৃদপিণ্ডের পেশি অনমনীয় বা শক্ত হয়ে যায়, ফলে রক্ত পাম্প করা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • এটি তুলনামূলক বিরল, কিন্তু বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
  • প্রধানত অ্যামিলয়েডোসিস, হেমোক্রোমাটোসিস বা স্ক্লেরোডার্মার মতো রোগের কারণে হয়।

আরিথমোজেনিক রাইট ভেন্ট্রিকুলার কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Arrhythmogenic Right Ventricular Cardiomyopathy – ARVC):

  • এটি সাধারণত বংশগত এবং এতে হৃদপিণ্ডের ডান ভেন্ট্রিকলের পেশি চর্বিযুক্ত ও আঁশযুক্ত টিস্যু দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়।
  • ফলে হৃদযন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ব্যাহত হয় এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন সৃষ্টি হয়।

লক্ষণ ও জটিলতা

প্রাথমিক পর্যায়ে কার্ডিওমায়োপ্যাথির তেমন কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে—

  • শ্বাসকষ্ট, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময়
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • পা, গোড়ালি ও পেটে পানি জমা (Edema)
  • বুক ব্যথা বা চাপ অনুভব করা
  • হৃদস্পন্দনের অনিয়ম (Arrhythmia), যার ফলে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে

এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার মধ্যে রয়েছে হার্ট ফেইলিউর, হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, রক্ত জমাট বাঁধা ও স্ট্রোক এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা স্থায়ীভাবে নষ্ট হওয়া।

নির্ণয় ও চিকিৎসা

কার্ডিওমায়োপ্যাথি নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়, যেমন—

  • ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG): হৃদস্পন্দনের সমস্যা শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  • ইকোকার্ডিওগ্রাম: হৃদযন্ত্রের আকার, গঠন ও কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
  • MRI ও CT স্ক্যান: হৃদযন্ত্রের গঠন বিশদভাবে দেখার জন্য ব্যবহার করা হয়।
  • বায়োপসি: হৃদপেশির নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে—

ওষুধ

বিটা-ব্লকার ও ACE ইনহিবিটর রক্তচাপ কমিয়ে হার্টের কার্যকারিতা উন্নত করে। ডিউরেটিক্স শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিয়ে হার্টের ওপর চাপ কমায়। অ্যান্টি-কোয়াগুলেন্ট রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

লাইফস্টাইল পরিবর্তন

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও কম লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করা। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা, তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়ানো। ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ পরিহার করা। মানসিক চাপ কমানো ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা।

সার্জারি ও চিকিৎসা পদ্ধতি

পেসমেকার বা ICD (Implantable Cardioverter Defibrillator) বসানো হয় যদি হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দনের ঝুঁকি বেশি থাকে। কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে যদি ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসায় কাজ না হয়।

হৃদরোগ প্রতিরোধে কিছু সাধারণ পরামর্শ

হৃদরোগ প্রতিরোধে সুস্থ জীবনযাত্রা ও সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি জীবনঘাতী হতে পারে এবং চিকিৎসার ব্যয়ও অনেক বেশি। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রথমেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পরিশোধিত চিনি ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার কমিয়ে বেশি পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (যেমন স্যামন, সার্ডিন) খাওয়া দরকার। উদাহরণস্বরূপ, নিয়মিত ব্রাউন রাইস ও ওটস খেলে কোলেস্টেরল কমে, যা হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো। পাশাপাশি, ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার, যেমন—ফাস্ট ফুড, প্রসেসড মিট, ও অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার পরিহার করা উচিত, কারণ এগুলো ধমনীতে চর্বি জমিয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।

শারীরিক কার্যক্রম হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা বা যোগব্যায়াম করলে হৃদযন্ত্র শক্তিশালী হয় এবং রক্ত সঞ্চালন ভালো থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়ামকারী ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে, যা হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, সকালের নাস্তার আগে ২০ মিনিটের দ্রুত হাঁটা হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

ধূমপান ও অ্যালকোহল হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ধূমপান ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করে এবং রক্তে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান প্রবেশ করিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ধূমপানকারী একজন ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ধূমপান না করা ব্যক্তির তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। তাই ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করা এবং অ্যালকোহল গ্রহণ থেকে বিরত থাকা হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য আবশ্যক।

মানসিক চাপ ও অনিদ্রা হৃদরোগের আরেকটি বড় কারণ। অতিরিক্ত কাজের চাপ, উদ্বেগ এবং ঘুমের অভাব রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘণ্টা) এবং মানসিক চাপ কমানোর কৌশল যেমন—বই পড়া, গান শোনা, অথবা প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যেসব ব্যক্তি প্রতিদিন ৭ ঘণ্টার কম ঘুমায়, তাদের উচ্চ রক্তচাপ ও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকি ২০-৩০% বেশি থাকে।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার, কারণ এগুলো হার্টের জন্য ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি ছয় মাস পরপর রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের পরীক্ষা করালে হৃদরোগের ঝুঁকি আগেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

সর্বোপরি, হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, মানসিক চাপ কমানো, পর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।

উপসংহার

আপনার-আমার হার্ট প্রতিনিয়ত শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে জীবনধারণের মূল ভিত্তি গড়ে তোলে। তবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং বংশগত কারণের কারণে হৃদযন্ত্রে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। হার্টের কি কি রোগ হতে পারে- সে সম্পর্কে তো জানলাম। করোনারি আর্টারি ডিজিজ (CAD), হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর, আরিথমিয়া, ভালভুলার ডিজিজসহ অসংখ্য হৃদরোগ আমাদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তাই হার্টের যত্ন নেওয়া এবং এর রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। হার্টের রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায়।

Related posts

Leave a Comment