হার্ট ব্লকেজ: লক্ষণ, কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা!

হার্ট ব্লকেজ: লক্ষণ, কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা!

ভাবুন তো, আপনি প্রতিদিন নিয়মমতো খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, কাজ করছেন- সবই ঠিকঠাক চলছে। হঠাৎ একদিন হালকা ব্যথা বা অস্বস্তি বুকে টের পেলেন। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে দিন পার করে দিলেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই সামান্য অস্বস্তির পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক “হার্ট ব্লকেজ”? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার মধ্যে অনেকেই আগে থেকে হার্ট ব্লকেজ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। বাংলাদেশেও প্রতি ৪ জন মৃত্যুর মধ্যে ১ জনের কারণ হচ্ছে হার্ট সম্পর্কিত জটিলতা। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব “ হার্ট ব্লকেজ: লক্ষণ , কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা” নিয়ে বিস্তারিত, সহজ ভাষায় এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসহ, যেন আপনি নিজে যেমন সচেতন হতে পারেন, তেমনি পরিবারকেও রক্ষা করতে পারেন।

হার্ট ব্লকেজ মূলত তখন হয় যখন রক্তবাহী ধমনীর (artery) ভেতরে চর্বি, কোলেস্টেরল, বা অন্যান্য পদার্থ জমে ব্লক সৃষ্টি করে। এই জমাট বাধা ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয়, যার ফলে হার্ট ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এটি প্রথম দিকে তেমন লক্ষণ দেখায় না, কিন্তু একসময় হঠাৎ করে ভয়ানক আকার ধারণ করে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেকেই হার্ট ব্লকেজের প্রাথমিক লক্ষণ চিনতে পারেন না বা গুরুত্ব দেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৪০ বছরের পর থেকেই সবার হার্টের স্বাস্থ্য নিয়ে পরীক্ষা করা উচিত। অথচ বাস্তবে, আমাদের দেশে এই বিষয়ে সচেতনতা খুবই কম। তাই আসুন, জেনে নিই কীভাবে “হার্ট ব্লকেজ: লক্ষণ, কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা” নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়।

হার্ট ব্লকেজ কী?

হার্ট ব্লকেজ হল একটি অবস্থা যেখানে হার্টে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী বা করোনারি আর্টারিগুলো আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আটকে যায়। এই ব্লকেজ সাধারণত ফ্যাটি পদার্থ, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য উপাদানের একটি স্তর তৈরি হওয়ার কারণে ঘটে, যাকে প্ল্যাক বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে এই প্ল্যাক জমে ধমনীগুলো সরু করে ফেলে, ফলে হার্টের পেশিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে ব্যথা (অ্যাঞ্জাইনা), শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি এমনকি হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।

হার্ট ব্লকেজের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা। অনেক সময় এই ব্লকেজ দীর্ঘদিন কোনো লক্ষণ ছাড়াও গোপনে বাড়তে থাকে, এবং একসময় হঠাৎ করে সমস্যা দেখা দেয়। হার্ট ব্লকেজ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, যেমন ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, স্ট্রেস টেস্ট বা এনজিওগ্রাফি। চিকিৎসা হিসেবে ওষুধ, লাইফস্টাইল পরিবর্তন, কিংবা প্রয়োজনে বাইপাস সার্জারি বা স্টেন্ট বসানো হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি জীবনঘাতী হতে পারে।

হার্ট ব্লকেজের সাধারণ ও উপেক্ষিত লক্ষণ

বুকে চাপ বা ব্যথা (Chest Pain)

বুকে চাপ বা ব্যথা হলো হার্ট ব্লকেজের সবচেয়ে পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। অনেক সময় এই ব্যথাটি মাঝখানে বা বাম পাশে অনুভূত হয় এবং এটি চেপে ধরা বা ভারী বোঝার মতো অনুভব হয়। এটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে এবং কখনো কখনো বিশ্রাম নিলেও পুরোপুরি চলে যায় না। অনেকেই একে অ্যাসিডিটির সমস্যা ভেবে অবহেলা করে ফেলেন, কিন্তু বাস্তবে এটি হার্টে রক্ত চলাচলে বাধার স্পষ্ট ইঙ্গিত হতে পারে।

আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো, এই ব্যথা শুধু বুকেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় এই ব্যথা কাঁধ, ঘাড়, পিঠ কিংবা বাম হাতে ছড়িয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় অনেকে সাধারণ ব্যথা ভেবে ওষুধ খেয়ে চুপ থাকেন, যার ফলে বড় বিপদ ঘনিয়ে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বুকে ব্যথার লক্ষণ অবহেলা করাই বেশিরভাগ হার্ট অ্যাটাকের কারণ। তাই সময়মতো ডাক্তার দেখানো ও ECG করার মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ণয় করা জরুরি।

হাঁটলে বা ব্যায়ামে শ্বাসকষ্ট

হঠাৎ হাঁটাহাঁটি বা হালকা ব্যায়াম করার পর যদি শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তবে সেটি হার্ট ব্লকেজের একটি স্পষ্ট লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে, আগে যেসব কাজ সহজে করতে পারতেন, এখন সেগুলো করতেই যদি হাঁপিয়ে যান বা বুকে চাপ অনুভব করেন- তবে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। এটা সাধারণ ফুসফুসজনিত সমস্যা নয় বরং হার্টে রক্ত সরবরাহে বাধা আসার কারণেই এই সমস্যা দেখা দেয়।

শ্বাসকষ্টের এই ধরনের পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়, তাই অনেকেই বিষয়টিকে বয়স বা ক্লান্তি বলে ভুল করেন। কিন্তু সত্যি কথা হলো, হার্ট যখন ঠিকভাবে রক্ত পায় না, তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না- ফলে দম বন্ধ হয়ে আসা, ক্লান্তি, এবং দুর্বলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে ৪০ বছরের ওপরে কেউ যদি শ্বাসকষ্টে ভোগেন, তাহলে অবশ্যই হার্টের পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

হাত বা ঘাড়ে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া

হার্ট ব্লকেজের সময় বুকে শুরু হওয়া ব্যথা অনেক সময় আশেপাশের অঙ্গগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাম হাত, ঘাড় বা গলায় ব্যথা ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এই ব্যথা সাধারণ ব্যথার মতো নয়; এটি ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং অনেক সময় পেশীতে টান ধরার মতো অনুভূত হয়। কেউ কেউ বলেন, যেন হাত ভারী হয়ে এসেছে বা অসাড় লাগছে।

এই লক্ষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে। অনেকেই ভাবেন হাত বা ঘাড়ে ব্যথা হয়তো ঘুমের কারণে হয়েছে বা পিঠে চাপ পড়েছে, তাই অবহেলা করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, ঘাম বা বুকে চাপও থাকে- তবে তা অবশ্যই একটি সতর্ক সংকেত। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে বিপদের সম্ভাবনা বাড়ে।

অতিরিক্ত ঘাম ও দুর্বলতা

স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘাম হওয়া, বিশেষ করে শীতকালে বা বিশ্রামের অবস্থায়, হার্ট ব্লকেজের একটি অজানা কিন্তু গুরুত্বপূ্র্ণ লক্ষণ। এটি শরীরের একটি রেসপন্স, যেটি হার্টের রক্ত সরবরাহে সমস্যা হলে দেখা দেয়। ঘাম সাধারণত ঠান্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে ধরনের হয়, যেটা চাপ বা ভয়ের কারণে হওয়া ঘামের চেয়েও ভিন্ন।

এই ঘামের পাশাপাশি দুর্বলতা যদি দেখা দেয়- যেমন হঠাৎ মনে হচ্ছে শরীরের শক্তি শেষ হয়ে গেছে, বা বিছানা থেকে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে- তবে সেটিও হতে পারে হার্টে অক্সিজেন পৌঁছানোর ঘাটতির ফল। এই লক্ষণগুলোকে যদি আমরা সাধারণ জ্বর বা কাজের চাপ ভেবে এড়িয়ে যাই, তবে তা জীবনঘাতী হতে পারে। তাই বারবার ক্লান্তি বা অস্বাভাবিক ঘাম হলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখানো উচিত।

হঠাৎ মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

মাথা ঘোরা বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া অনেকেই স্বাভাবিক বা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে ধরে নেন। কিন্তু এটি যদি বারবার ঘটে এবং বিশেষ করে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হয়, তাহলে সেটি হার্ট ব্লকেজের কারণে হতে পারে। রক্তপ্রবাহ ঠিকমতো না হলে মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, ফলে মাথা ঘোরে বা ব্ল্যাকআউট হয়।

অনেক সময় এই লক্ষণটি হার্ট অ্যাটাকের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা দেয়। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা ওবেসিটির সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে মাথা ঘোরা বা চেতনা হারানো আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত এবং প্রয়োজন হলে ইসিজি ও অন্যান্য পরীক্ষা করানো দরকার।

কী কী কারণে হয় হার্ট ব্লকেজ?

উচ্চ কোলেস্টেরল (High Cholesterol)

উচ্চ কোলেস্টেরল হলো হার্ট ব্লকেজের সবচেয়ে প্রধান ও প্রমাণিত কারণগুলোর একটি। আমাদের রক্তে যদি এলডিএল (LDL) বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’-এর পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, তাহলে তা ধমনীতে জমে যায় এবং রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে। ধীরে ধীরে এই চর্বি জমা হয়ে প্লাক তৈরি করে যা হার্টে অক্সিজেন সরবরাহের পথ আটকে দেয়। একসময় এই প্লাক ছিঁড়ে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকও ঘটাতে পারে।

মজার বিষয় হলো, কোলেস্টেরল অনেক সময় কোনো লক্ষণ ছাড়াই ধীরে ধীরে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে যেসব মানুষ ফাস্ট ফুড, ভাজা-পোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার নিয়মিত খান, তাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। সময়মতো রক্ত পরীক্ষা না করলে তা জানা যায় না। তাই ৩০ বছরের পর থেকে রুটিন কোলেস্টেরল চেক-আপ অত্যন্ত জরুরি।

ধূমপান ও মদ্যপান

ধূমপান হার্ট ব্লকেজের একটি নীরব ঘাতক। সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে থাকা নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড রক্তনালিকে সংকুচিত করে এবং রক্তে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে ধমনির দেয়ালে প্লাক জমে ব্লক তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি ধূমপান না করা মানুষের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি।

মদ্যপানও হার্টের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে যারা নিয়মিত বা অতিরিক্ত পান করেন। এটি উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি এবং কোলেস্টেরল বাড়ানোর মাধ্যমে ধমনিকে দুর্বল করে তোলে। অনেক সময় মদ্যপান হৃদপিণ্ডের পেশিকে দুর্বল করে দেয়, যাকে বলে “Alcoholic Cardiomyopathy”। ধূমপান-মদ্যপানের এই অভ্যাস পরিহার করাই হার্ট সুস্থ রাখার অন্যতম চাবিকাঠি।

মিষ্টি ও চর্বিযুক্ত খাবারের অভ্যাস

খাদ্যাভ্যাস হার্টের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মিষ্টি, ময়দা, তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে শরীরে ক্যালোরি জমে, যা ধীরে ধীরে ওজন বাড়ায় ও শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ধমনীতে চর্বি জমে ব্লকেজ তৈরি হয়। তেল-মসলা জাতীয় খাবার যেমন বিরিয়ানি, ফাস্টফুড, ফ্রায়েড আইটেম বেশি খেলে এই সমস্যা আরো বাড়ে।

চমকে দেওয়ার মতো তথ্য হলো- যেসব মানুষ প্রতিদিন ট্রান্সফ্যাট বা প্রসেসড ফুড (যেমন কেক, বিস্কুট, প্যাকেটজাত খাবার) খান, তাদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ৩০% বেশি। এর কারণ এসব খাবারে কোলেস্টেরল বাড়ানো উপাদান থাকে যা সরাসরি ধমনিতে জমে। তাই খাবারে পরিমাণ, পুষ্টিগুণ এবং ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ

ডায়াবেটিস বা রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকলে ধমনির দেয়াল নরম ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে রক্তনালিতে চর্বি সহজেই জমে গিয়ে ব্লক তৈরি করে। ডায়াবেটিস রোগীরা অনেক সময় বুঝতেই পারেন না যে তাদের হার্টে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, কারণ অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক হয় নীরবভাবে। তাই এই রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশি।

উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে, রক্তনালিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে যা ধমনির অভ্যন্তরীণ দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ক্ষতস্থানে প্লাক জমে ব্লকেজ সৃষ্টি হয়। উচ্চ রক্তচাপও ধমনী সংকোচন ঘটিয়ে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে। নিয়মিত প্রেসার মাপা, ওষুধ খাওয়া এবং লবণ নিয়ন্ত্রণই এই ঝুঁকি কমাতে পারে। এই দুই রোগই হার্ট ব্লকেজের ‘সাইলেন্ট কিলার’ হিসেবে পরিচিত।

মানসিক চাপ ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন

আজকের ব্যস্ত জীবনে মানসিক চাপ যেন নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আপনি জানেন কি, দীর্ঘ সময় মানসিক চাপ থাকলে তা শরীরে কর্টিসল নামক হরমোন বাড়িয়ে তোলে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়? স্ট্রেসের কারণে আমরা অনিয়মিত খাবার খাই, ঘুম কম হয়, ব্যায়াম বন্ধ হয়ে যায়- সব মিলিয়ে হার্ট ব্লকেজের পথ তৈরি হয় ধীরে ধীরে।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন- যেমন সারাদিন বসে থাকা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, একটানা কাজ করে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব অভ্যাস শরীরে রক্তচাপ, সুগার এবং কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তোলে। তাই শুধু ওষুধ নয়, বরং সচেতন জীবনযাপন, রুটিনে হাঁটা, ঘুম, আর ব্যালেন্সড ডায়েটই হার্টকে সুস্থ রাখার মূলমন্ত্র।

কিভাবে নির্ণয় করা হয় হার্ট ব্লকেজ?

ইসিজি (ECG – Electrocardiogram)

ইসিজি হলো হার্ট ব্লকেজ শনাক্ত করার সবচেয়ে প্রাথমিক এবং সহজলভ্য পদ্ধতি। এই পরীক্ষায় হার্টের বৈদ্যুতিক সংকেত (electrical signals) পরিমাপ করা হয়। হার্ট যখন ব্লকেজের কারণে ঠিকমতো রক্ত pumped করতে পারে না, তখন তার বৈদ্যুতিক কার্যক্রমে পরিবর্তন আসে- এবং তা ইসিজি রিপোর্টে ধরা পড়ে। বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি নিয়ে হাসপাতালে গেলে প্রথমেই সাধারণত ইসিজি করা হয়।

ইসিজি দ্রুত এবং ব্যথাহীন একটি প্রক্রিয়া। তবে সব সময় এটি ১০০% নির্ভরযোগ্য নয়, বিশেষ করে যদি ব্লকেজ আংশিক হয় বা তা একেবারে শুরু পর্যায়ে থাকে। তবুও এটি হার্ট অ্যাটাকের আগাম সংকেত শনাক্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারো হার্টের ইতিহাস থাকলে নিয়মিত ইসিজি করিয়ে রাখা উচিত, যাতে সমস্যা আগেভাগেই ধরা পড়ে।

ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram)

ইকোকার্ডিওগ্রাম একটি আল্ট্রাসাউন্ড-ভিত্তিক টেস্ট যার মাধ্যমে হার্টের গঠন, চলাচল এবং রক্তপ্রবাহ সরাসরি স্ক্রিনে দেখা যায়। এই পদ্ধতিতে ধমনির সংকোচন, হার্টের পেশির দুর্বলতা কিংবা ব্লকেজের কারণে রক্তের প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে কি না, তা দেখা যায়। ইকো একরকম চোখে হার্টের কার্যক্রম দেখার সুযোগ দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যাদের বুকে চাপ, শ্বাসকষ্ট বা দুর্বলতা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে ইকো পরীক্ষায় ব্লকেজের ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়। এটি শিশু থেকে বৃদ্ধ- সব বয়সের জন্য নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন একটি পদ্ধতি। তবে এটি সম্পূর্ণ নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেয় না, বরং অন্য পরীক্ষার পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ট্রেডমিল টেস্ট (TMT)

ট্রেডমিল টেস্ট বা স্ট্রেস টেস্ট এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে রোগীকে ট্রেডমিলের উপর হাঁটতে বা দৌড়াতে বলা হয় এবং সেই সময় তার হার্টের কার্যক্রম ইসিজির মাধ্যমে মনিটর করা হয়। এই টেস্টের মাধ্যমে বোঝা যায় ব্যায়াম বা চাপের সময় হার্ট ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে পারছে কি না। যদি ব্লকেজ থাকে, তবে শরীরচর্চার সময়ই লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

TMT মূলত হার্ট ব্লকেজের কার্যকরী উপস্থিতি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। অনেক সময় বিশ্রামের সময় ইসিজি বা ইকোতে কিছু ধরা পড়ে না, কিন্তু TMT করলে সেই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে। তবে যাদের আগেই হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে বা হার্ট দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এই টেস্ট ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে- তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়।

এনজিওগ্রাফি (Coronary Angiography)

এনজিওগ্রাফি হলো হার্ট ব্লকেজ নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভুল এবং চূড়ান্ত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় একটি বিশেষ রং (contrast dye) রক্তনালিতে প্রবেশ করানো হয় এবং এক্স-রে মেশিন দিয়ে সেই রংয়ের চলাচল পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেখানেই রক্ত চলতে না পারে, সেখানেই বোঝা যায় ব্লকেজ রয়েছে। এনজিওগ্রাফির মাধ্যমে ঠিক কত শতাংশ ব্লকেজ, কোন ধমনিতে, এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ- সব কিছু জানা যায়।

এটি কিছুটা ইনভেসিভ (অর্থাৎ শরীরের মধ্যে ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হয়), তাই সাধারণত এটি তখনই করা হয় যখন বাকি পরীক্ষায় হার্ট ব্লকেজের সন্দেহ থাকে বা রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়। এই টেস্টের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি লাগবে কি না। বর্তমানে এটি অনেক হাসপাতালে আধুনিক প্রযুক্তিতে অল্প সময়েই সম্পন্ন হয়।

হার্ট ব্লকেজের চিকিৎসা পদ্ধতি

ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা (Medication)

প্রাথমিক ও মাঝারি পর্যায়ের হার্ট ব্লকেজে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা বেশ কার্যকর হতে পারে। সাধারণত রক্ত পাতলা করার জন্য অ্যাসপিরিন, কোলেস্টেরল কমাতে স্ট্যাটিন, এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিটা-ব্লকার জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এসব ওষুধ হার্টে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, নতুন প্লাক তৈরি হওয়া ঠেকায় এবং বিদ্যমান প্লাকের ক্ষতি থেকে হার্টকে সুরক্ষা দেয়।

তবে এই চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী এবং নিয়মিত ফলোআপ প্রয়োজন হয়। অনেক রোগী ভাবেন ওষুধ কিছুদিন খেলেই ব্লকেজ ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবে ওষুধ থামিয়ে দিলে সমস্যা আবার ফিরে আসে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়া, সময়মতো চেকআপ করানো এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রতি সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।

এনজিওপ্লাস্টি (Angioplasty)

যখন ব্লকেজ গুরুতর হয় এবং শুধু ওষুধে কাজ হয় না, তখন চিকিৎসক এনজিওপ্লাস্টি করার পরামর্শ দেন। এই প্রক্রিয়ায় ধমনীতে একটি পাতলা টিউবের মাধ্যমে বেলুন ঢুকিয়ে ব্লকেজ জায়গাটি প্রসারিত করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সেখানে একটি স্টেন্ট বসানো হয় যাতে ব্লক আবার না হয়। এনজিওপ্লাস্টি অপেক্ষাকৃত কম সময়ের এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ সার্জারি।

বিশেষ করে যারা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে আছেন বা যাদের ধমনিতে ৭০%-এর বেশি ব্লক রয়েছে, তাদের জন্য এটি জীবনরক্ষাকারী হতে পারে। তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়, যদি জীবনধারা ঠিক না করা হয় বা ওষুধ নিয়মিত না খাওয়া হয়, তাহলে পুনরায় ব্লকেজ হতে পারে। তাই এনজিওপ্লাস্টির পরেও নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাইপাস সার্জারি (Bypass Surgery)

যখন একাধিক ধমনীতে জটিল ব্লকেজ থাকে বা ব্লকেজ এমন জায়গায় যেখানে স্টেন্ট বসানো সম্ভব নয়, তখন চিকিৎসক করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং (CABG) বা সংক্ষেপে বাইপাস সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রক্রিয়ায় শরীরের অন্য অংশ থেকে একটি সুস্থ রক্তনালি নিয়ে ব্লক অংশকে বাইপাস করে হার্টে রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।

বাইপাস একটি জটিল ও খরচবহুল অপারেশন হলেও, অনেক রোগীর ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘমেয়াদী মুক্তির পথ তৈরি করে। সফল বাইপাসের পর রোগীরা সাধারণত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন, তবে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওষুধ সেবন এবং জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হয়। এটি একবারেই শেষ নয়- পরবর্তী যত্নই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনধারা পরিবর্তন (Lifestyle Modification)

কোনো চিকিৎসাই স্থায়ী সমাধান নয় যদি জীবনধারায় পরিবর্তন না আসে। হার্ট ব্লকেজ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার সফলতা নির্ভর করে একজন মানুষ কীভাবে নিজের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করেন তার ওপর। সুষম খাদ্য, নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম, ধূমপান-মদ্যপান পরিহার, মানসিক চাপ কমানো, এবং পর্যাপ্ত ঘুম- এসবই হার্টকে সুস্থ রাখার ভিত্তি।

গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনধারা পরিবর্তন করলে হার্ট ব্লকেজ প্রাকৃতিক উপায়ে কিছুটা কমে আসতেও পারে। অনেক সময় যারা ছোটখাটো ব্লকেজে ভুগছেন, শুধু এই পদ্ধতিতেই তাদের হার্ট সুস্থ রাখা সম্ভব হয়। তাই চিকিৎসা শুধু হাসপাতালেই সীমাবদ্ধ নয়- প্রতিদিনের জীবনেও চলে এর যুদ্ধ।

উপসংহার

একটি সুস্থ হৃদয়ই একটি সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি। “হার্ট ব্লকেজ: লক্ষণ, কারণ, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা” নিয়ে আজকে আমরা যেসব তথ্য জানলাম, তা শুধুমাত্র জ্ঞানের জন্য নয়- বরং জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয়। হার্ট ব্লকেজকে অবহেলা করলে তা নিঃশব্দ ঘাতকের মতো আচমকা আঘাত হানে। অথচ, সময়মতো লক্ষণগুলো চিনে নেওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস (যেমন ধূমপান, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়া, অলস জীবনযাপন) বাদ দেওয়া, এবং সঠিক সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যমে এই ভয়ংকর বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, আপনি নিজের যত্ন না নিলে কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। তাই নিজে সচেতন হন, প্রিয়জনদের সচেতন করুন, এবং হৃদয়ের যত্ন নিন। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার- আর নয় অবহেলা, নয় অজ্ঞানতা, হার্ট ব্লকেজকে পরাজিত করতে হবে সচেতনতা ও কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে।

Related posts

Leave a Comment