হৃদরোগের কারণ ও চিকিৎসা- Heart disease

হৃদরোগের কারণ ও চিকিৎসা- Heart disease

একটি হৃদস্পন্দন থেমে গেলে শুধু একটি জীবনই থেমে যায় না, থমকে যায় একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি ভবিষ্যৎ। আধুনিক বিশ্বে হৃদরোগের প্রকোপ এতটাই বেড়ে গেছে যে এটি এখন বৈশ্বিক মহামারির রূপ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগের কারণ এ মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২%। শুধু বাংলাদেশেই প্রতিবছর ২ লাখের বেশি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। অথচ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই মরণব্যাধি প্রতিরোধযোগ্য!

বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ওজন বৃদ্ধি ও মানসিক চাপ- এই সমস্ত কারণ হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের ব্যস্ত জীবনযাত্রা, জাঙ্ক ফুডের প্রতি আসক্তি এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ক্রমেই আমাদের হৃদযন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন আনলেই হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—কীভাবে? তবে চলুন, আজকের এই আর্টিকেলে আমরা সে সম্পর্কেই বিস্তারিত জেনে আসি। 

হৃদরোগের কারণ

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত চর্বি, লবণ এবং চিনি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে রক্তনালীতে প্লাক জমে, যা ধমনী সংকুচিত করে এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এসব খাবার শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ফল, শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার না খেলে হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায় না।

অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ এবং অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ওজন বৃদ্ধি ঘটায়, যা হৃদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। দেহের বিপাকক্রিয়া ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুষম খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যথাযথ পরিমাণে প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তির খাদ্যতালিকায় প্রচুর ফাইবার এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। তাই হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

শরীরচর্চার অভাব ও স্থূলতা

নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে শরীরের বিপাকক্রিয়া সক্রিয় থাকে, যা অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। তবে যারা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলেন এবং অলস জীবনযাপন করেন, তাদের মধ্যে হৃদরোগের হার অনেক বেশি দেখা যায়। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা যোগব্যায়ামের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।

স্থূলতা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত ওজন হলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ে, যা রক্তনালীতে চর্বি জমার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। স্থূল ব্যক্তিদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও মেটাবলিক সিনড্রোমের প্রবণতা বেশি থাকে, যা হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার মাধ্যমে স্থূলতা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।

ধূমপান ও মদ্যপান

ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম গুরুতর কারণ। তামাকজাত পণ্য গ্রহণের ফলে শরীরে নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড প্রবেশ করে, যা ধমনী সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে ধূমপানের ফলে আর্টারিতে প্লাক জমতে থাকে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান হৃদরোগের কারণ হিসেবে ৩০-৪০% ভূমিকা রাখে এবং এটি হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। ধূমপান ছেড়ে দিলে কয়েক মাসের মধ্যেই রক্তচলাচল উন্নত হয় এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ে।

অতিরিক্ত মদ্যপানও হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অ্যালকোহল লিভারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে, যা বিপাকক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। মদ্যপানের ফলে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যায়, যা হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন যে, মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা বা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

হৃদরোগের কারণ

উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল

উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। যখন রক্তচাপ দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, তখন এটি ধমনীগুলোর দেয়ালে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, যার ফলে হার্টের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, যা রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং হৃদপিণ্ডে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

অন্যদিকে, কোলেস্টেরলও হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে এটি ধমনীর দেয়ালে জমে গিয়ে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস তৈরি করে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষত, “খারাপ” কোলেস্টেরল (LDL) বৃদ্ধি এবং “ভাল” কোলেস্টেরল (HDL) কমে গেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলযুক্ত প্লাক জমতে থাকলে ধমনীগুলো সরু হয়ে যায় এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, যা হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অন্যান্য কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার কারণ হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক

ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মধ্যে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে বেশি থাকে, তখন এটি ধমনীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয় এবং রক্ত চলাচলের পথ সংকুচিত করে। ফলে হৃদপিণ্ডে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ও উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রবণতা বেশি থাকে, যা হৃদরোগের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

ডায়াবেটিস হৃদরোগ সৃষ্টি করে মূলত ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে। যখন শরীর ইনসুলিনকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না, তখন রক্তে চর্বি ও শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যা ধমনীর ক্ষতি করে। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, ব্যায়াম এবং নিয়মিত চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বংশগত প্রভাব ও জেনেটিক্স

অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগের পেছনে বংশগত কারণ ও জেনেটিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি পরিবারের কোনো সদস্য আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এই ঝুঁকি বাড়তে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ কিছু জিন মানুষের হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলে এবং ধমনীগুলোর কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে। যদি বাবা-মায়ের কেউ উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস বহন করেন, তাহলে সন্তানদের মধ্যে এসব সমস্যার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।

বংশগত হৃদরোগের প্রবণতা থাকলে জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন যে, যাদের পরিবারের কারও হৃদরোগের ইতিহাস রয়েছে, তারা অল্প বয়স থেকেই স্বাস্থ্যসচেতন জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে ভবিষ্যতে মারাত্মক হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পেতে পারে।

অতিরিক্ত স্ট্রেস ও মানসিক চাপ

অতিরিক্ত স্ট্রেস এবং মানসিক চাপ হৃদরোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যখন কেউ দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপে থাকেন, তখন শরীর কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ করে, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও ধমনী সংকোচনের মতো সমস্যার সৃষ্টি করে। মানসিক চাপজনিত উদ্বেগ ও ডিপ্রেশন থাকলে অনেকে ধূমপান, মদ্যপান বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যা হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।

স্ট্রেস হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর কারণ এটি দেহের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া বাড়ায় এবং ধমনীগুলোর ক্ষতি করে। ক্রনিক স্ট্রেসের ফলে হৃদপিণ্ডের রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং অ্যারিথমিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা দিতে পারে। মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক স্বস্তি বজায় রাখার মাধ্যমে স্ট্রেস কমিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

দূষণ ও হৃদরোগের সংযোগ

বায়ুদূষণ হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাতাসে অতিরিক্ত পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড এবং সূক্ষ্ম ধূলিকণা (PM2.5) থাকলে তা শ্বাসপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করে এবং ধমনীগুলোতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। বাতাসের দূষিত উপাদান হৃদযন্ত্রের কোষগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়, যার ফলে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।

শুধু বায়ুদূষণ নয়, শব্দ ও মানসিক দূষণও হৃদরোগের জন্য ক্ষতিকর। ক্রমাগত উচ্চ শব্দে বসবাস করলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং অনিদ্রা ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের কারণ হতে পারে। শহরাঞ্চলের যানজট, কলকারখানার দূষণ এবং ধোঁয়া হৃদপিণ্ডের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে শুদ্ধ বাতাসে পর্যাপ্ত সময় ব্যায়াম করা, মাস্ক পরিধান করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মেনে চলা জরুরি।

হৃদরোগের চিকিৎসা পদ্ধতি

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

হৃদরোগ চিরতরে বিদায় জানাতে হলে সবার আগে যেটি প্রয়োজন তা হলো- জীবনযাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসা।

স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ (কম চর্বি ও লবণযুক্ত খাবার)

হৃদরোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেশি চর্বিযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ধমনীর দেওয়ালে প্লাক তৈরি করে, যা রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই খাদ্যতালিকা থেকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন—ফাস্ট ফুড, ভাজা খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস বাদ দেওয়া উচিত। বরং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (স্যামন, টুনা), বাদাম, অলিভ অয়েল এবং শাকসবজি বেশি পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন।

লবণ বেশি গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা সরাসরি হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। প্রক্রিয়াজাত খাবার, সস এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। পরিবর্তে, পটাসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন—কলা, পালংশাক, মিষ্টি আলু এবং ডাল গ্রহণ করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।

নিয়মিত ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ

হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়ামের ফলে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে, ধমনীগুলো সুস্থ থাকে এবং শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট কমে যায়। বিশেষ করে, কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম যেমন—দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এবং যোগব্যায়াম হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট উচ্চমাত্রার ব্যায়াম করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।

অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগের অন্যতম কারণ। স্থূলতার ফলে শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) বৃদ্ধি পায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) কমে যায়, যা ধমনীগুলোকে সংকুচিত করে এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য হৃদরোগজনিত সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই সুস্থ হৃদপিণ্ডের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।

ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার

ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। সিগারেটের নিকোটিন এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ধমনীগুলো সংকুচিত করে এবং রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। তাছাড়া, ধূমপানের ফলে রক্তের অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, যা হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকি কমতে শুরু করে এবং এক বছরের মধ্যে এই ঝুঁকি প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।

অ্যালকোহল অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এটি ট্রাইগ্লিসারাইড (এক ধরনের ফ্যাট) বৃদ্ধি করে, যা ধমনীর ভেতরে প্লাক জমিয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ হার্ট ফেইলিওর, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি।

মানসিক চাপ কমানো ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম

মানসিক চাপ হৃদরোগের অন্যতম বড় কারণ। অতিরিক্ত স্ট্রেস থাকলে দেহে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন মানসিক চাপে থাকলে ধমনীগুলো সংকুচিত হয়ে যায় এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্রেস কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া দরকার। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট মেডিটেশন বা ধ্যান করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে।

পর্যাপ্ত ঘুম হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। অনিয়মিত ঘুম হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ বাড়ায় এবং দেহে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়তে পারে, যা সরাসরি হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই সুস্থ হৃদপিণ্ডের জন্য মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

হৃদরোগের চিকিৎসা পদ্ধতি

ওষুধ ও মেডিকেশন

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ (যেমন: বিটা ব্লকার, এসিই ইনহিবিটর)

উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায়, এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিটা ব্লকার (Beta Blocker) হলো এমন একটি ওষুধের শ্রেণি, যা হৃদযন্ত্রের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই ওষুধ হৃদপিণ্ডের বীট কমিয়ে দেয় এবং রক্তচাপ হ্রাস করে, ফলে হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় না। এটি এনজাইনা (বুকে ব্যথা), অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। সাধারণত মেটোপ্রোলল (Metoprolol), এটেনোলোল (Atenolol) এবং প্রোপ্রানোলোল (Propranolol) ইত্যাদি ওষুধ বিটা ব্লকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে, এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মাথাঘোরা, অবসাদ ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি গ্রহণ করা উচিত নয়।

এসিই ইনহিবিটর (ACE Inhibitor) উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ, যা রক্তনালীগুলোকে প্রশস্ত করে এবং রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখে। এটি শরীরে অ্যাঞ্জিওটেনসিন-II নামক হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা রক্তনালীগুলো সংকুচিত করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে এবং হৃদপিণ্ডের উপর চাপ কমে যায়। রেমিপ্রিল (Ramipril), লিসিনোপ্রিল (Lisinopril) এবং ক্যাপটোপ্রিল (Captopril) হলো বেশ কয়েকটি সাধারণ এসিই ইনহিবিটর। এই ওষুধ উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি কিডনির সমস্যার ঝুঁকি কমায় এবং হার্ট ফেইলিওর প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে এটি গ্রহণ করলে কিছু ক্ষেত্রে শুকনো কাশি, মাথাব্যথা ও হালকা মাথা ঘোরার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ (যেমন: স্ট্যাটিন)

কোলেস্টেরল হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ, কারণ এটি ধমনীর মধ্যে জমে গিয়ে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস সৃষ্টি করে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্যাটিন (Statin) হলো এক ধরনের ওষুধ, যা যকৃতে (লিভারে) কোলেস্টেরল উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং রক্তে “খারাপ” কোলেস্টেরল (LDL) হ্রাস করতে সহায়তা করে। এটি ধমনীগুলোর মধ্যে জমে থাকা চর্বি বা প্লাক কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। অ্যাটরভাস্ট্যাটিন (Atorvastatin), রোসুভাস্ট্যাটিন (Rosuvastatin) এবং সিমভাস্ট্যাটিন (Simvastatin) হলো সবচেয়ে প্রচলিত স্ট্যাটিন ওষুধ।

হৃদরোগের প্রাথমিক লক্ষণ কি কি? লক্ষণ প্রকাশ পেলে যা করণীয়!

স্ট্যাটিন কেবলমাত্র কোলেস্টেরল কমায় না, বরং ধমনীতে প্রদাহ কমিয়ে হৃদরোগের অন্যান্য জটিলতাও প্রতিরোধ করে। এটি হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুনরায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কমায়। তবে, স্ট্যাটিন গ্রহণের ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন- পেশী ব্যথা, লিভারের সমস্যা, হজমের সমস্যা বা দুর্বলতা। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে কোলেস্টেরলের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। স্ট্যাটিন ছাড়াও, ফাইব্রেটস (Fibrates) এবং নাইাসিন (Niacin) জাতীয় ওষুধ কোলেস্টেরল কমাতে ব্যবহার করা হয়, তবে এগুলোর প্রয়োগ তুলনামূলক কম।

ব্লাড থিনার (রক্ত পাতলা করার ওষুধ) (যেমন: অ্যাসপিরিন)

হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্লাড থিনার বা রক্ত পাতলা করার ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন রক্ত অতিরিক্ত ঘন হয়ে যায়, তখন এটি সহজেই জমাট বাঁধতে পারে, যা হৃদপিণ্ডের ধমনীতে ব্লকেজ তৈরি করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে। ব্লাড থিনার ওষুধ রক্তের প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা কমায়। অ্যাসপিরিন (Aspirin) অন্যতম জনপ্রিয় ব্লাড থিনার, যা প্লাটিলেটের কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং রক্তকে তরল রাখে। এটি হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত কার্যকর।

তবে, অ্যাসপিরিন দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে পাকস্থলীর ক্ষতি হতে পারে এবং রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটি গ্রহণ করা উচিত নয়। অ্যাসপিরিন ছাড়াও অন্যান্য ব্লাড থিনার ওষুধ রয়েছে, যেমন- ওয়ারফারিন (Warfarin), হেপারিন (Heparin) এবং ক্লপিডোগ্রেল (Clopidogrel)। এই ওষুধগুলো সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হয়। রক্তপাতজনিত সমস্যা এড়াতে, এই ধরনের ওষুধ গ্রহণের সময় নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ (যদি প্রয়োজন হয়)

ডায়াবেটিস হৃদরোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি বৃদ্ধি করে, কারণ এটি ধমনীগুলোকে শক্ত ও সংকুচিত করে এবং হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। তাই, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেটফরমিন (Metformin) হলো সবচেয়ে প্রচলিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে শরীরকে রক্তে থাকা গ্লুকোজ ব্যবহার করতে সাহায্য করে এবং লিভার থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ উৎপাদন কমায়।

ইনসুলিন থেরাপিও কিছু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত যদি তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। এছাড়াও, এসজিএলটি-২ ইনহিবিটর (SGLT2 Inhibitor) ওষুধ, যেমন- এমপাগ্লিফ্লোজিন (Empagliflozin) এবং ক্যানাগ্লিফ্লোজিন (Canagliflozin), ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য জিএলপি-১ রিসেপ্টর অ্যাগোনিস্ট (GLP-1 Receptor Agonist) ওষুধ, যেমন- লিরাগ্লুটাইড (Liraglutide) বা ডুলাগ্লুটাইড (Dulaglutide), নির্ধারণ করা হয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা কমানোর পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাত্রার পরিবর্তন, যেমন- সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানোর কৌশল গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা হলে ডায়াবেটিসজনিত হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

মেডিক্যাল প্রসিডিউর ও সার্জারি

এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্ট বসানো – বন্ধ হওয়া ধমনী খুলতে

এনজিওপ্লাস্টি হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ব্লক হয়ে যাওয়া বা সংকুচিত ধমনীগুলোকে প্রসারিত করা হয়, যাতে হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। হৃদরোগের কারণে যখন ধমনীগুলোতে চর্বি ও কোলেস্টেরল জমে যায়, তখন তা রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে একটি ক্ষুদ্র নল (ক্যাটেথার) ধমনীর সংকুচিত স্থানে প্রবেশ করানো হয় এবং এরপর সেখানে একটি ছোট বেলুন ফোলানো হয়। এতে ধমনীর সংকীর্ণ অংশ প্রসারিত হয় এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।

স্টেন্ট বসানো এনজিওপ্লাস্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এনজিওপ্লাস্টির পর অনেক ক্ষেত্রে ধমনী পুনরায় সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সমস্যা সমাধানে ধমনীর ভেতরে একটি ছোট ধাতব জালিকা (স্টেন্ট) স্থাপন করা হয়, যা ধমনীগুলোকে খোলা রাখতে সাহায্য করে। বর্তমানে মেডিসিন-লেপিত স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়, যা ধমনীর মধ্যে নতুন ব্লক সৃষ্টি হওয়া প্রতিরোধ করে। এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্ট বসানো তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং দ্রুত পুনরুদ্ধারযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি, যা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে কার্যকর।

বাইপাস সার্জারি – ব্লক হওয়া ধমনী বাইপাস করে বিকল্প পথ তৈরি

বাইপাস সার্জারি (Coronary Artery Bypass Graft Surgery – CABG) হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি উন্নত ও কার্যকর সার্জিকাল পদ্ধতি। যখন ধমনীগুলোতে গুরুতর ব্লকেজ তৈরি হয় এবং এনজিওপ্লাস্টি বা ওষুধ দিয়ে সমাধান সম্ভব হয় না, তখন বাইপাস সার্জারি করা হয়। এই পদ্ধতিতে শরীরের অন্য কোনো অংশ (যেমন পা, বাহু, বা বুকের ভেতরকার ধমনী) থেকে একটি সুস্থ ধমনী বা শিরা নেওয়া হয় এবং ব্লক হয়ে যাওয়া ধমনীর পরিবর্তে তা বসানো হয়। এটি হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচলের জন্য নতুন বিকল্প পথ তৈরি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায় এবং রোগীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

বাইপাস সার্জারি মূলত তাদের জন্য প্রয়োজনীয়, যাদের একাধিক ধমনী ব্লক হয়ে গেছে বা প্রধান ধমনীগুলোর ব্লকেজের মাত্রা অত্যধিক। এটি একটি বড় ধরনের অপারেশন হলেও, সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে রোগীর হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং জীবনমান উন্নত করে। এই সার্জারি করার পর রোগীদের অবশ্যই জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হয়, যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধ সেবন এবং স্ট্রেস কমানো, যাতে হৃদরোগের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

পেসমেকার প্রতিস্থাপন – অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ঠিক রাখতে

পেসমেকার একটি ছোট ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখতে সহায়তা করে। যখন হৃদপিণ্ড খুব ধীরে বা অনিয়মিতভাবে স্পন্দিত হয়, তখন পেসমেকার হৃদযন্ত্রকে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মাধ্যমে সংকোচন ও প্রসারণের সংকেত দেয়, যা হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখে। সাধারণত, ব্র্যাডিকার্ডিয়া (অতি ধীর হৃদস্পন্দন), ট্যাকিকার্ডিয়া (অতি দ্রুত হৃদস্পন্দন) বা হার্ট ব্লকের মতো সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে পেসমেকার স্থাপন করা হয়।

পেসমেকার প্রতিস্থাপন একটি তুলনামূলক সহজ ও নিরাপদ সার্জারি। এটি বুকের চামড়ার নিচে স্থাপন করা হয় এবং ছোট তারের মাধ্যমে এটি হৃদযন্ত্রের সাথে সংযুক্ত থাকে। আধুনিক পেসমেকারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে হৃদস্পন্দনের গতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সংকেত প্রেরণ করে। এই ডিভাইসটি হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে, রোগীর কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং অপ্রত্যাশিত হৃদরোগজনিত জটিলতা কমিয়ে আনে।

হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট – গুরুতর অবস্থায় হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন

যেসব রোগীদের হৃদযন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অন্য কোনো চিকিৎসা কার্যকর হচ্ছে না, তাদের জন্য হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট বা হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন শেষ আশ্রয়স্থল হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় একটি সুস্থ দাতা হৃদযন্ত্র গ্রহণ করে তা রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি মূলত হৃদপিণ্ডের চূড়ান্ত পর্যায়ের ব্যর্থতা (End-Stage Heart Failure) বা মারাত্মক কার্ডিওমায়োপ্যাথি রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট একটি অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা সফল করতে রোগীর শরীরকে নতুন হৃদযন্ত্র গ্রহণে প্রস্তুত করতে হয়। প্রতিস্থাপনের পর রোগীদের জীবনের বাকি সময়জুড়ে ইমিউনোসপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন করতে হয়, যাতে শরীর নতুন হৃদযন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান না করে। এই সার্জারি রোগীদের জীবন বাঁচাতে পারে, তবে দাতা হৃদযন্ত্রের অপ্রতুলতা এবং অপারেশন-পরবর্তী জটিলতা এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

উপসংহার

হৃদরোগ আর কেবল বয়স্কদের সমস্যা নয়, তরুণদের মাঝেও এর প্রকোপ ভয়াবহভাবে বাড়ছে। প্রযুক্তির প্রসার আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের অলস জীবনধারার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান বর্জন, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক চাপ কমানো- এই সহজ অথচ কার্যকর কিছু অভ্যাসই আমাদের হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে পারে। মনে রাখতে হবে, হৃদরোগ প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে অনেক সহজ, সস্তা এবং কার্যকর! তাই সচেতন হোন, জীবন বাঁচান! ধন্যবাদ।

Related posts

Leave a Comment