হার্টের রোগ কি কারণে হয়? জানলে অবাক হবেন!

হার্টের রোগ কি কারণে হয়

হঠাৎ বুকের ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট, আর তারপর একরাশ নিস্তব্ধতা!- হ্যাঁ,এটাই হতে পারে একজন হার্ট অ্যাটাকের শিকার ব্যক্তির শেষ মুহূর্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হার্টের রোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩১%। আমাদের চারপাশে হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য হৃদরোগের ঘটনা এতটাই বেড়ে গেছে যে, অনেকেই এটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হার্টের রোগ কি কারণে হয়? -এটা কি কেবল বয়সের দোষ, নাকি আমাদের জীবনধারাই ধীরে ধীরে আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

একসময় ভাবা হতো, হার্টের রোগ শুধু বয়স্কদের সমস্যা। কিন্তু বর্তমান পরিসংখ্যান ভয়ঙ্কর এক বাস্তবতা তুলে ধরছে। ২০-৩০ বছর বয়সীদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর চাপপূর্ণ জীবনযাপন হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। চলুন আজকের এই লেখা থেকে জেনে নিই, হার্টের রোগ কি কি কারণে হতে পারে। 

কেন হার্টের রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি?

হার্টের রোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মানসিক চাপ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ইত্যাদি কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। হার্টের সমস্যাগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণগুলো অনেক সময় বোঝা যায় না, ফলে মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পায় না বা গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যদি শুরু থেকেই হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়, তাহলে এই মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন—সুস্থ জীবনধারা অনুসরণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ব্যালান্সড ডায়েট গ্রহণ এবং ধূমপান বা অ্যালকোহল পরিহার করার মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়। হার্টের সমস্যা সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি ও স্থূলতার কারণে হয়ে থাকে। তাই এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হৃদরোগ হলে শুধু ব্যক্তির জীবনই ঝুঁকির মুখে পড়ে না, বরং তার পরিবার এবং কর্মজীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন ব্যক্তি যদি অকালে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন, তাহলে তার পরিবারের অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ বেড়ে যায়। কর্মক্ষম মানুষ কমে গেলে সামাজিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সচেতনতার মাধ্যমে আমরা শুধু ব্যক্তিগত সুস্থতাই নিশ্চিত করতে পারি না, বরং সামগ্রিকভাবে একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত পরিমাণে লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তাই হৃদরোগ সম্পর্কে আগেভাগেই জানা এবং সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা আমাদের এবং আমাদের আশপাশের মানুষদের সুস্থ রাখতে পারি।

হার্টের রোগ কি কারণে হয়?

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের কারণে অনেকে নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতে পারেন না, যা হার্টের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে আমাদের দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে নানা জটিল শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক মানুষ সময়মতো খাবার খান না, পর্যাপ্ত পানি পান করেন না এবং নিজেদের বিশ্রাম ও রিলাক্সেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেন না। এছাড়া মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে না রাখার ফলে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা পরবর্তীতে হার্টের বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের আরেকটি বড় সমস্যা হলো অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের প্রতি আসক্তি। যেমন—দীর্ঘ সময় বসে থাকা, অতিরিক্ত ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ করা ইত্যাদি। অনেকেই নিজেদের ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করেন না বা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেন না, যার ফলে হার্টের কার্যক্ষমতা ক্রমাগত কমতে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ধীরে ধীরে দেহের মেটাবলিজম ও রক্তসঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটায়, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তাই সুস্থ হার্টের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি।

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (চর্বি ও ফাস্টফুড গ্রহণ)

বর্তমানে ফাস্টফুড এবং চর্বিযুক্ত খাবারের প্রতি মানুষের আকর্ষণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে, যা হার্টের রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ফাস্টফুড সাধারণত ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, উচ্চমাত্রার সোডিয়াম ও প্রক্রিয়াজাত উপাদানসমৃদ্ধ হয়, যা শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ধমনীতে জমে গিয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিমাণে চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে ওজন বৃদ্ধি পায়, যা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা তৈরি করে।

এছাড়া, অধিকাংশ ফাস্টফুডে পুষ্টিগুণ থাকে কম এবং ক্যালোরির পরিমাণ বেশি, যা দেহের মেটাবলিজম ধীর করে দেয় এবং হৃৎপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। বাজারে পাওয়া সফটড্রিংকস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিজ্জার মতো খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও লবণ থাকে, যা রক্তচাপ বাড়ায় এবং রক্তনালী সংকুচিত করে। তাই স্বাস্থ্যকর হার্টের জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা জরুরি। বেশি পরিমাণে সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার ও প্রোটিন গ্রহণ করলে হার্টের সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব।

শারীরিক পরিশ্রমের অভাব

শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়ার ফলে হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে নানা ধরনের রোগের জন্ম দেয়। বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনের কারণে অনেক মানুষই দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, ফলে শরীরের রক্তসঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মেদ বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের অভাবে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়, যা হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি ইত্যাদি রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন না, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শুধু ওজন বৃদ্ধির কারণ নয়, এটি মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর থেকে এন্ডরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু যারা কোনো ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করেন না, তাদের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বাড়ে এবং তা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে, যা সরাসরি হার্টের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং, যোগব্যায়াম বা যেকোনো শারীরিক পরিশ্রম করা অত্যন্ত জরুরি।

অনিয়মিত ঘুম

পর্যাপ্ত এবং মানসম্পন্ন ঘুম সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক মানুষই ব্যস্ততা, স্ট্রেস বা প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পর্যাপ্ত ঘুম পেতে পারেন না। অনিয়মিত ঘুমের ফলে শরীরের সার্বিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে কর্টিসল এবং অ্যাড্রেনালিন নামক স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিত ঘুম হার্ট ফেইলিওর, উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের কারণ হতে পারে।

এছাড়া, যারা প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান, তাদের ক্ষেত্রে স্থূলতা, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি থাকে। ঘুমের সময় আমাদের শরীর নিজেকে রিপেয়ার করে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে, যা হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। তাই নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা দরকার। ভালো ঘুমের জন্য রাত জাগা কমানো, শুতে যাওয়ার আগে ফোন বা ল্যাপটপের স্ক্রিন কম দেখা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা এবং আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধূমপান ও অ্যালকোহল

ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকজাত পণ্যের মধ্যে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রক্তনালী সংকুচিত করে এবং ধীরে ধীরে আর্টারিগুলোতে প্লাক জমতে সাহায্য করে। এর ফলে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। দীর্ঘদিন ধূমপান করলে উচ্চ রক্তচাপ, আর্টারির স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া এবং রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ে, যা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপানের ফলে শরীরের “লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন” (LDL) বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা ধমনীতে চর্বির আস্তরণ তৈরি করে। একই সঙ্গে এটি “হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন” (HDL) বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপান ত্যাগ করলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে এবং কয়েক মাসের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

অ্যালকোহল গ্রহণও হৃদরোগের অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করলে রক্তচাপ বাড়ে এবং এটি হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করে। নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে হার্টের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে কার্ডিওমায়োপ্যাথি (cardiomyopathy) নামক সমস্যা দেখা দেয়, যা হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া অ্যালকোহল লিভারে চর্বি জমার কারণ হয়, যা শরীরে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন (Arrhythmia) হতে পারে, যা হার্ট ফেইলিউর বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই সুস্থ হৃদপিণ্ড বজায় রাখতে ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ

হার্টের রোগ কি কারণে হয়ে থাকে তার অন্যতম কারণ হলো মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে শরীরে “কর্টিসল” ও “অ্যাড্রেনালিন” হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ থাকলে রক্তনালীগুলো সংকুচিত হতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া মানসিক চাপ থাকলে অনেকেই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেমন—অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান বা অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করা। এসব অভ্যাস ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা দুর্বল করে এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।

উদ্বেগ বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাও হার্টের জন্য ক্ষতিকর। উদ্বেগজনিত সমস্যায় অনেকের হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যায়, যা হার্ট অ্যারিথমিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া উদ্বেগের ফলে ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদী হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। ক্রমাগত উদ্বেগে থাকলে শরীরের প্রদাহের মাত্রা বেড়ে যায়, যা ধমনীতে চর্বি জমার হার বাড়িয়ে দেয়। মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান, যোগব্যায়াম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্র বজায় রাখতে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।

উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল

উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) হলো “নীরব ঘাতক”, যা ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করে এবং হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। যখন রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তখন হৃদপিণ্ডকে রক্ত পাম্প করার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, যা সময়ের সাথে হার্টের পেশিগুলোকে দুর্বল করে ফেলে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনীর দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ধীরে ধীরে এথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis) বা ধমনী সংকীর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে হৃদপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অপরদিকে, উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। কোলেস্টেরল দুই ধরনের হয়—ভালো (HDL) এবং খারাপ (LDL)। যখন রক্তে LDL-এর পরিমাণ বেশি হয়, তখন এটি ধমনীর দেয়ালে জমে প্লাক তৈরি করে, যা রক্তপ্রবাহ ব্যাহত করে। সময়ের সাথে সাথে এই প্লাকগুলো ধমনীর পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কম লবণযুক্ত খাবার, স্বাস্থ্যকর চর্বি, প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করলে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়।

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক

ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ডায়াবেটিস থাকলে শরীরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যা ধমনীর অভ্যন্তরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে ধমনীগুলো সংকুচিত করে ফেলে। এটি এথেরোস্ক্লেরোসিসের (Atherosclerosis) কারণ হয়, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ডায়াবেটিস থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়, কারণ এটি রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও স্থূলতা বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।

ডায়াবেটিস হৃদপিণ্ডের রক্তনালী ও স্নায়ুগুলোর ক্ষতি করে, যার ফলে হার্ট ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এটি “ডায়াবেটিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি” (Diabetic Cardiomyopathy) নামক জটিলতা তৈরি করতে পারে, যা হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং হার্ট ফেইলিউরের দিকে নিয়ে যায়। ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমে গিয়ে রক্তনালীর দেয়ালে চর্বির আস্তরণ বাড়িয়ে দেয়, ফলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে এবং সুস্থ অভ্যাস গড়ে তুললে ডায়াবেটিসজনিত হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

হার্টের রোগ প্রতিরোধে কিছু সাধারণ টিপস

সুস্থ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন:

  • সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, সম্পূর্ণ শস্য ও প্রোটিনযুক্ত খাবার খান।
  • চর্বিযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুন।
  • অতিরিক্ত লবণ ও চিনি খাওয়া এড়িয়ে চলুন।

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন:

  • প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যোগব্যায়াম বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন।

ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন:

  • ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য পরিহার করুন।
  • অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ করুন।

রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করুন:

  • নিয়মিত রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন:

  • রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

মানসিক চাপ কমান:

  • ধ্যান, যোগব্যায়াম বা মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন।
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন।

পর্যাপ্ত পানি পান করুন:

  • প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
  • শরীরের হাইড্রেশন ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন কিছু রসাল ফলফুল খেতে পারেন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন:

  • বছরে অন্তত একবার হার্ট চেকআপ করান।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ECG, ব্লাড প্রেসার, সুগার ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করুন।

পরিশেষে, 

বিজ্ঞান ও চিকিৎসা যতই উন্নত হোক, হার্টের রোগ প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি কিন্তু আমাদের হাতেই। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই এই নীরব ঘাতককে প্রতিহত করা সম্ভব। হার্টের রোগ কি কারণে হয়? -এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখলাম আমাদের অসচেতনতা আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই হার্টের রোগের প্রধান কারণ। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার, নয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই রোগ আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। ধন্যবাদ এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য। আসসালামুয়ালাইকুম।

Related posts

Leave a Comment