হার্টের সমস্যা গুলো কি কি এবং কিভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়?

হার্টের সমস্যা

প্রতি মিনিটে একজন, প্রতি ঘণ্টায় ৬০ জন, প্রতিদিন হাজারের বেশি মানুষ হার্টের সমস্যায় মারা যাচ্ছে! আপনি কি জানতেন, বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে হার্টের সমস্যা অন্যতম? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হার্টের রোগে প্রাণ হারায়, যা মোট মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। অথচ একটু সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন করলে এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান কমানো সম্ভব।

আজকের ব্যস্ত জীবনযাত্রা, ফাস্টফুডের প্রতি আসক্তি, মানসিক চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত রুটিন আমাদের হার্টের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি তৈরি করছে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই জানি, হার্টের সমস্যা বলতে কী বোঝায়? এটি কি শুধুই হার্ট অ্যাটাক, নাকি আরও গভীর এবং জটিল কিছু? এই আর্টিকেলে আমরা হার্টের সমস্যার বিভিন্ন কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের জন্য জীবনরক্ষাকারীও তথ্য হতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত সাথেই থাকুন। 

কেন হার্টের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে?

বর্তমানে হার্টের সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। আধুনিক ব্যস্ত জীবনে মানুষ দ্রুতগতির খাবারের (ফাস্ট ফুড) প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং উচ্চমাত্রার সোডিয়ামযুক্ত। এগুলো ধমনীতে কোলেস্টেরল জমিয়ে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা এবং অনিদ্রার কারণে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটির মতো সমস্যা দেখা দেয়, যা হার্টের অসুস্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া, অতিরিক্ত মানসিক চাপও হৃদরোগ বৃদ্ধির একটি বড় কারণ, কারণ এটি শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং হার্টের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে।

এছাড়াও, ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণের মতো অভ্যাস হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপান রক্তনালী সংকুচিত করে এবং রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়। অপরদিকে, বায়ুদূষণ এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ও হার্টের সমস্যার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ দূষিত বাতাস শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে। এ ছাড়া, জেনেটিক কারণে বা বংশগতভাবে অনেকের হার্টের সমস্যা হতে পারে, তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে সচেতন জীবনধারা অনুসরণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

হার্টের সমস্যা গুলো কি কি?

হার্টের সমস্যা মানেই যে হার্ট অ্যাটাক বা এমন কিছু- তা কিন্তু নয়। হার্টের বিভিন্ন রকম সমস্যা হতে পারে। চলুন কিছু সাধারণ হার্টের সমস্যা সম্পর্কে জেনে নিই। 

হৃদরোগ (Cardiovascular Diseases – CVDs)

হৃদরোগ বা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (CVDs) হলো এমন একটি রোগসমূহের শ্রেণি, যা মূলত হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালীর সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো করোনারি আর্টারি ডিজিজ (Coronary Artery Disease – CAD), যেখানে ধমনীর ভেতর চর্বি জমে সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের আধিক্য, ধূমপান ও স্থূলতা হৃদরোগের অন্যতম কারণ। এছাড়া, অপরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়মিত ব্যায়াম হৃদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার দিকে নিয়ে যায়।

এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে বুকে ব্যথা (অ্যাঞ্জাইনা), শ্বাসকষ্ট, অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং মাথা ঘোরা। যদি সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়া হয়, তবে এটি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা হার্ট ফেইলিওরের মতো গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। হৃদরোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত চিকিৎসা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকাংশে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction – MI)

হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (MI) ঘটে যখন হৃদপিণ্ডের কোনো অংশে রক্ত প্রবাহ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে হৃদযন্ত্রের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে ধ্বংস হতে শুরু করে। সাধারণত এটি ঘটে করোনারি আর্টারি ব্লক হয়ে যাওয়ার কারণে, যা ধমনীতে প্লাক জমে সংকুচিত হয়ে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান, ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ। পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, যেমন—বুকের ব্যথা ছাড়াও ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, পিঠ বা কাঁধের ব্যথা ইত্যাদি দেখা যেতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে তীব্র চাপ বা সংকোচন অনুভূত হওয়া, যা কয়েক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়। অনেক সময় ব্যথা কাঁধ, বাহু, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না করলে এটি মারাত্মক হতে পারে এবং জীবনহানির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া উচিত। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হার্ট ফেইলিওর (Heart Failure)

হার্ট ফেইলিওর এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে এবং পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। সাধারণত এটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর হয়ে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ডায়াবেটিস, কার্ডিওমায়োপ্যাথি এবং থাইরয়েডের সমস্যা থেকে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। হৃদপিণ্ড যখন শরীরের অক্সিজেন ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে না, তখন বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়, যার ফলে দেহে তরল জমে ফোলা অনুভূত হয়।

হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, পায়ের গোড়ালি ও পায়ের ফোলা, রাতের বেলায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এবং অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি জীবনহানির কারণ হতে পারে। সঠিক ওষুধ গ্রহণ, জীবনধারা পরিবর্তন, লবণ ও জলীয় খাবারের নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ব্যায়াম করা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia)

অ্যারিথমিয়া হলো হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দন, যেখানে হার্ট খুব ধীরে বা খুব দ্রুত স্পন্দিত হতে পারে, কিংবা অস্বাভাবিকভাবে স্পন্দিত হতে পারে। এটি তখনই ঘটে যখন হৃদযন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালগুলোতে সমস্যা দেখা দেয়, ফলে হার্টের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়। অ্যারিথমিয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন—ব্র্যাডিকার্ডিয়া (হার্ট রেট অত্যন্ত ধীর), ট্যাচিকার্ডিয়া (হার্ট রেট অত্যন্ত দ্রুত), অথবা অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (হৃদযন্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত স্পন্দন)। উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ, ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স, ধূমপান, অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল গ্রহণ অ্যারিথমিয়ার কারণ হতে পারে।

এই রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদযন্ত্রের ধকধকানি, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বুকে অস্বস্তি এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। যদিও কিছু অ্যারিথমিয়া তেমন ক্ষতিকর নয়, তবে মারাত্মক ক্ষেত্রে এটি স্ট্রোক বা হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে। অ্যারিথমিয়ার চিকিৎসার জন্য ওষুধ, পেসমেকার, ক্যাথেটার অ্যাব্লেশন, কিংবা সার্জারির মতো পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (Congenital Heart Disease – জন্মগত হৃদরোগ)

কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (CHD) হলো জন্মগত হৃদযন্ত্রের ত্রুটি, যা শিশু জন্মের সময় থেকেই উপস্থিত থাকে। এটি হৃদযন্ত্রের গঠনগত সমস্যার কারণে হয়, যেমন—হৃদপিণ্ডের ছিদ্র, রক্তনালীর অস্বাভাবিক গঠন, কিংবা হৃদযন্ত্রের ভালভজনিত সমস্যা। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জেনেটিক ফ্যাক্টর, গর্ভাবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণ, মায়ের অপুষ্টি, মায়ের ডায়াবেটিস বা ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ।

CHD-এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুদের শ্বাসকষ্ট, খাওয়ার সময় ক্লান্ত হয়ে পড়া, ওজন কমে যাওয়া, নীলাভ ত্বক এবং অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন। গুরুতর অবস্থায় এটি অস্ত্রোপচার বা হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে অনেক শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardiomyopathy – হার্টের পেশির দুর্বলতা)

কার্ডিওমায়োপ্যাথি হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে হৃদযন্ত্রের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায়। এটি প্রধানত তিন প্রকার—ডাইলেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি, হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি এবং রেস্ট্রিকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ভাইরাল সংক্রমণ, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং জেনেটিক কারণ এই রোগের জন্য দায়ী।

এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, পা ও পায়ের গোড়ালি ফোলা, বুকব্যথা, ক্লান্তি এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন। চিকিৎসার জন্য জীবনধারা পরিবর্তন, ওষুধ, আইসিডি প্রতিস্থাপন এবং কিছু ক্ষেত্রে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন হতে পারে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে কার্ডিওমায়োপ্যাথি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

হার্টের সমস্যার কারণ হিসেবে দায়ী যারা

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

বর্তমান ব্যস্ত জীবনে মানুষ দ্রুত ও সহজলভ্য খাবারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর। উচ্চ চর্বিযুক্ত, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে, ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড, ফ্রায়েড ফুড এবং অতিরিক্ত লাল মাংস খাওয়ার ফলে রক্তনালীগুলোতে চর্বি জমে (প্লাক তৈরি হয়), যা ধমনীগুলো সংকুচিত করে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। ফলস্বরূপ, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি এবং করোনারি আর্টারি ডিজিজের মতো জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে এবং দীর্ঘমেয়াদে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়াও, পর্যাপ্ত শাকসবজি, ফলমূল, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ফাইবারযুক্ত খাবার না খেলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, যা হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হতে পারে এবং অ্যারিথমিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা দিতে পারে। তাই হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, কম পরিমাণে লবণ ও চিনি এবং প্রচুর শাকসবজি ও ফল রাখা উচিত, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।

অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা

দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যখন কোনো ব্যক্তি দীর্ঘসময় ধরে মানসিক চাপে থাকেন, তখন শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার মানসিক চাপের কারণে রক্তনালী সংকুচিত হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া, মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে অনেকেই অতিরিক্ত খাওয়া, ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন কিংবা শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দেন, যা হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়। মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং ইতিবাচক জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।

ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন

ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকজাত পণ্য গ্রহণের ফলে শরীরে নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড প্রবেশ করে, যা রক্তনালীগুলো সংকুচিত করে এবং রক্তের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে অধিক পরিশ্রম করতে হয়, যা ধীরে ধীরে হার্টের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ধূমপান করোনারি আর্টারি ডিজিজ, অ্যারিথমিয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার ধূমপান না করা ব্যক্তিদের তুলনায় ২-৪ গুণ বেশি।

অন্যদিকে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনও হার্টের জন্য ক্ষতিকর। এটি উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি এবং কার্ডিওমায়োপ্যাথির কারণ হতে পারে। অ্যালকোহল সরাসরি হৃদপেশিগুলো দুর্বল করে, যা দীর্ঘমেয়াদে হার্ট ফেইলিওর বা হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে শরীরে অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড জমে, যা রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করাই সবচেয়ে ভালো।

উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) ও উচ্চ কোলেস্টেরল

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এমন একটি অবস্থা যেখানে ধমনীগুলোর ভেতরে রক্তপ্রবাহের চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, ফলে হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ রক্তনালীকে দুর্বল করে ফেলে এবং প্লাক জমার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। অপরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, ধূমপান ও শরীরচর্চার অভাব উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণ।

অন্যদিকে, উচ্চ কোলেস্টেরলও হৃদরোগের অন্যতম কারণ। শরীরে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমে গেলে এটি রক্তনালীর গায়ে আটকে থাকে এবং রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, এলডিএল (Low-Density Lipoprotein) কোলেস্টেরলকে ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বলা হয়, কারণ এটি ধমনীতে প্লাক তৈরি করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ওবেসিটি ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন

ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন হৃদরোগের অন্যতম বড় কারণ। অতিরিক্ত ওজন হলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে, যা হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত করে এবং রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং কার্ডিওমায়োপ্যাথির ঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্থূল ব্যক্তিদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি।

অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনও হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য দায়ী। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো এবং মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত জরুরি।

বংশগত কারণ ও জিনগত সমস্যা

বংশগত কারণ ও জিনগত সমস্যাও অনেক সময় হৃদরোগের জন্য দায়ী হতে পারে। যদি পরিবারের কারও হৃদরোগ থাকে, তবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে, যদি বাবা-মা বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের কারও কম বয়সে হৃদরোগ হয়ে থাকে, তবে সেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও এই ঝুঁকি বেশি থাকে।

এছাড়া, কিছু জিনগত সমস্যা রয়েছে, যেমন—হাইপারটেনশন, হাই কোলেস্টেরল বা কার্ডিওমায়োপ্যাথি, যা বংশগতভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও জিনগত সমস্যাগুলি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

কিভাবে হার্টের সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়?

সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা

হার্টের সুস্থতা নিশ্চিত করতে প্রথমেই সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, লীন প্রোটিন (যেমন মাছ, মুরগির মাংস), স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (যেমন অলিভ অয়েল, বাদাম, অ্যাভোকাডো) এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার (যেমন ওটস, ব্রাউন রাইস) অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এসব খাবার শরীরের কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং রক্তনালীগুলোর কার্যকারিতা উন্নত করে। বিশেষ করে, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ (যেমন স্যামন, টুনা) হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে এবং রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখে।

অন্যদিকে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত, ভাজা-পোড়া, প্রক্রিয়াজাত এবং বেশি লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার ধমনীগুলোতে প্লাক তৈরি করে, যা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ফাস্ট ফুড, সোডা, বেশি প্রসেসড খাবার এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণও হার্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য পরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা

শরীরচর্চা হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। নিয়মিত ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, ওজন নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম (যেমন হাঁটা, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা) বা ৭৫ মিনিট উচ্চমাত্রার ব্যায়াম (যেমন দৌড়ানো, ওয়েট লিফটিং) করা উচিত। হাঁটাহাঁটি ও দৌড়াদৌড়ি হৃদযন্ত্রের পাম্পিং ক্ষমতা বাড়িয়ে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।

শারীরিক কার্যক্রমের অভাব ধমনীগুলোতে চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ায়, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। যারা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন, তাদের জন্য কিছু বিরতি নিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটা বা স্ট্রেচিং করা জরুরি। নিয়মিত ব্যায়াম করলে দেহের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে দেয় না। তাই হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে প্রতিদিন কিছু সময় ব্যায়াম করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা

হৃদরোগ প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম না হলে শরীরে কর্টিসল ও স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কম ঘুমের ফলে হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং এটি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অনিদ্রা ও অনিয়মিত ঘুমের কারণে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।

অন্যদিকে, মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। যখন কেউ অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, তখন শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং ধমনীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন মানসিক চাপ বজায় থাকলে এটি উচ্চ রক্তচাপ, আর্থেরোস্ক্লেরোসিস এবং হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। তাই মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান, মেডিটেশন, ইয়োগা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পছন্দের কাজে সময় দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা

ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে নিকোটিন ও কার্বন মনোক্সাইড শরীরে প্রবেশ করে, যা রক্তনালী সংকুচিত করে এবং হৃদপিণ্ডের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস করে। ধূমপান উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, ধমনীতে প্লাক তৈরি করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান হৃদরোগজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এবং যারা ধূমপান ত্যাগ করেন, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

অন্যদিকে, অ্যালকোহল হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে যদি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হয়। অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়ায়, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং কার্ডিওমায়োপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে হার্টের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে, যা হার্ট ফেইলিওরের দিকে নিয়ে যায়। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধে ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করাই সবচেয়ে ভালো।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হৃদরোগ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগের লক্ষণগুলো দীর্ঘদিন ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং যখন তা প্রকাশ পায়, তখন চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে যায়। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণ আগেভাগেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে, ৩০ বছরের পর থেকে বছরে অন্তত একবার হার্ট চেকআপ করা উচিত।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল লেভেল, রক্তের সুগারের মাত্রা এবং ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG) পরীক্ষা করা জরুরি। যদি পরিবারে কারও হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তবে আরও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

জরুরি করণীয়: কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?

হঠাৎ তীব্র বুকের ব্যথা অনুভব করলে

যদি হঠাৎ করে তীব্র বুকের ব্যথা অনুভূত হয়, তবে সেটিকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ এটি হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে প্রচণ্ড চাপ বা জ্বালাপোড়া ধরনের ব্যথা অনুভূত হয়, যা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে অথবা মাঝে মাঝে কমতে-বাড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, এই ব্যথার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘাম, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব এবং দুর্বলতা দেখা দেয়। এটি সাধারণ গ্যাসের ব্যথা ভেবে উপেক্ষা করলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে। তাই তীব্র বুকের ব্যথা হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

বুকের ব্যথা সব সময় হার্ট অ্যাটাকের কারণে হয় না, তবে এটি অ্যাঞ্জাইনা (Angina), অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia), বা পালমোনারি এম্বোলিজমের (Pulmonary Embolism) মতো গুরুতর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। অ্যাঞ্জাইনা হলে হার্টে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে বুকের ব্যথা হয়, যা সাধারণত বিশ্রাম নিলে কিছুটা কমে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হলে ব্যথা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং বিশ্রামেও আরাম পাওয়া যায় না। তাই বুকের ব্যথার প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

শ্বাসকষ্ট হলে বা জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলে

শ্বাসকষ্ট হলে বা হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি গুরুতর হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। হার্ট পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত পাম্প করতে না পারলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে, যদি কোনো ব্যক্তি হালকা পরিশ্রমের পরও সহজে হাঁপিয়ে যান বা স্বাভাবিক শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, তবে এটি হার্ট ফেইলিওর, পালমোনারি এডেমা (Pulmonary Edema) বা হার্টের ভালভের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। কখনো কখনো, ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে পারে, যা কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওরের (Congestive Heart Failure) অন্যতম উপসর্গ।

যদি শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বুকে ব্যথা, হালকা মাথাব্যথা, চেতনা হারানোর অনুভূতি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। হার্টের সমস্যা ছাড়াও, ফুসফুসের রোগ (যেমন COPD বা অ্যাজমা) থেকেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তবে যদি এটি আকস্মিকভাবে ঘটে এবং ধীরে ধীরে তীব্র হয়, তবে এটি হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণ হতে পারে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে অবিলম্বে জরুরি চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

বুকের ব্যথার পাশাপাশি হাত, কাঁধ বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লে

বুকের ব্যথার পাশাপাশি যদি ব্যথা হাতে, কাঁধে বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটি সাধারণত হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে, বাম হাত বা কাঁধে ব্যথা অনুভূত হলে এবং সেটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে, দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অনেক ক্ষেত্রে, এই ব্যথা শুধু বুকে থাকে না; এটি হাতের দিকে নেমে যায়, গলায় চাপ অনুভূত হয় এবং চোয়ালে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে এটি পিঠের ওপরের অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

নারীদের ক্ষেত্রে বুকের ব্যথা ছাড়াও কাঁধ, ঘাড় এবং চোয়ালের ব্যথা প্রধান লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়। এটি অনেক সময় অ্যাসিডিটি বা পেশির ব্যথার মতো মনে হতে পারে, কিন্তু যদি ব্যথাটি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা বিশ্রামেও স্বাভাবিক না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক মানুষ হার্ট অ্যাটাকের আগে কিছুদিন ধরে সামান্য ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করে, যা পরে গুরুতর আকার ধারণ করে। তাই বুকের ব্যথার সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা অনুভূত হলে অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।

অনিয়মিত হৃদস্পন্দন অনুভব করলে

স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বার হয়ে থাকে, তবে যদি হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যায়, তখন তা হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। কখনো হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত (টাকিকার্ডিয়া) বা খুব ধীরগতির (ব্রাডিকার্ডিয়া) হয়ে যেতে পারে, যা অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। যদি হৃদস্পন্দন হঠাৎ করে অনিয়মিত হয়ে যায় এবং সঙ্গে মাথা ঘোরা, বুকে চাপ, দুর্বলতা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

অনেক সময় মানসিক চাপ, ক্লান্তি বা ক্যাফেইনের অতিরিক্ত গ্রহণের কারণে সাময়িকভাবে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে, তবে যদি এটি বারবার ঘটে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এটি অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia) বা অন্য কোনো কার্ডিয়াক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হার্ট ফেইলিওর, ভালভের সমস্যা বা হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণেও হতে পারে। তাই হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে এবং মারাত্মক সমস্যা এড়াতে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

উপসংহার

একটি সুস্থ শরীর সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অল্প বয়সেই অনেক মানুষ হার্টের সমস্যার শিকার হচ্ছেন, যা আগে শুধু বয়স্কদের মধ্যেই দেখা যেত। প্রযুক্তির যুগে আমাদের হাতে এত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও, আমরা নিজেদের সুস্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছি। তবে সুখবর হলো, হার্টের সমস্যা প্রতিরোধযোগ্য! স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে আপনি সহজেই এই মরণব্যাধি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন। মনে রাখবেন, সচেতনতা এবং ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তনই আপনাকে দীর্ঘায়ু এবং সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারে!

Related posts

Leave a Comment