হার্টের সমস্যা হলে কি কি অসুবিধা হয় এবং তাৎক্ষণিক করণীয়!

হার্টের সমস্যা হলে কি কি অসুবিধা হয়

একটা মুহূর্ত… শুধু একটা মুহূর্ত! কল্পনা করুন, সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে—আপনি হাঁটছেন, হাসছেন, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। হঠাৎ বুকের ভেতর তীব্র চাপ, শ্বাস নিতে কষ্ট, দৃষ্টিতে অন্ধকার নেমে আসছে! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে দুলতে শুরু করলেন। জ্বি, এটাই হৃদরোগের নিষ্ঠুরতম বাস্তবতা- যা এক মুহূর্তেই জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারে। জানতে চান, হার্টের সমস্যা হলে কি কি অসুবিধা হয়? আরো বিস্তারিত জানতে হলে পুরো আর্টিকেলটি মন দিয়ে পড়ুন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যা বৈশ্বিক মৃত্যুর প্রধান কারণ। শুধু বাংলাদেশেই প্রতি বছর দুই লাখের বেশি মানুষ হার্টের সমস্যায় ভোগে, অথচ সময়মতো সচেতনতা ও চিকিৎসা পেলে এই সংখ্যাটি অনেক কমানো সম্ভব। হৃদরোগ শুধুমাত্র বয়স্কদের সমস্যা নয় -আজকাল তরুণরাও এর শিকার হচ্ছে, যার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক চাপ। কিন্তু আশার কথা হলো, একটু সচেতনতা আর জীবনধারায় পরিবর্তন আনলেই এই প্রাণঘাতী রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হার্টের সমস্যা হলে কি কি অসুবিধা হয়?

হার্ট আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শরীরের প্রতিটি অংশে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে। যদি হার্ট ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে পুরো শরীরের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। হৃদরোগের কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। নিচে হার্টের সমস্যার ফলে সৃষ্ট কিছু প্রধান অসুবিধার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো-

শ্বাসকষ্ট ও শারীরিক দুর্বলতা

হার্ট ঠিকমতো কাজ না করলে শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত হয় না, ফলে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এই কারণে অনেক মানুষ শ্বাসকষ্ট অনুভব করে, বিশেষত যখন তারা হাঁটাহাঁটি বা কোনো পরিশ্রমের কাজ করে। হার্ট ফেইলিউর বা করোনারি আর্টারি ডিজিজের কারণে ফুসফুসে তরল জমতে পারে, যা শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ। রাতে ঘুমানোর সময় বা সোজা হয়ে শুয়ে থাকলে এই সমস্যা আরও তীব্র হতে পারে।

শুধু শ্বাসকষ্ট নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, যার ফলে রোগীরা সহজেই ক্লান্ত হয়ে যায়। স্বাভাবিক কাজ যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, হাঁটা বা বাজার করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় রোগীরা সামান্য কাজ করেও প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করেন এবং বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘদিন এ সমস্যা চলতে থাকলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং কর্মক্ষমতা কমে যায়।

বুকে ব্যথা ও অস্বস্তি

হৃদরোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো বুকে ব্যথা, যা অ্যাঞ্জাইনা (Angina) নামে পরিচিত। এটি সাধারণত হৃদযন্ত্রে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ না হওয়ার কারণে হয়। হার্টের ধমনী সংকীর্ণ হয়ে গেলে বা ব্লক হয়ে গেলে বুকের মাঝে বা বাঁ পাশে চাপ অনুভূত হয়, যা অনেক সময় গলা, বাহু, পিঠ বা পেটেও ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যথা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে এবং শারীরিক পরিশ্রমের পর বেড়ে যেতে পারে।

এছাড়া, হার্ট অ্যাটাকের সময় তীব্র ব্যথা হতে পারে, যা অনেকের ক্ষেত্রে জীবনহানির কারণ হতে পারে। কখনও কখনও রোগীরা বুকের ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা ও বমির অনুভূতি অনুভব করতে পারেন। অনেকেই এই ব্যথাকে সাধারণ গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটির ব্যথা বলে ভুল করেন, ফলে দেরিতে চিকিৎসা শুরু হয়। তাই বুকে ব্যথা হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হাত-পা ও শরীর ফুলে যাওয়া

হার্ট ঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরের বিভিন্ন অংশে তরল জমতে পারে, যা এডিমা (Edema) নামে পরিচিত। বিশেষ করে, হার্ট ফেইলিউরের কারণে পা, গোড়ালি, হাত এবং কখনও কখনও পেটে পানি জমতে পারে। এটি হয় কারণ হার্ট যখন রক্ত ঠিকমতো পাম্প করতে পারে না, তখন অতিরিক্ত তরল শরীরে জমতে শুরু করে।

শুধু বাহ্যিক ফোলাভাবই নয়, এই তরল জমে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর কার্যকারিতায়ও প্রভাব ফেলে। কিডনি এবং লিভারের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে, যার ফলে শরীরে আরও বেশি তরল জমে যায়। ফলে হাঁটা-চলা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, জুতো বা পোশাক টাইট লাগতে পারে, এমনকি রাতে ঘুমানোর সময় অস্বস্তিও হয়। এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসা না করালে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও মাথা ঘোরা

হার্টের সমস্যা থাকলে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হতে পারে, যা অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia) নামে পরিচিত। এটি তখন হয় যখন হার্টের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ঠিকভাবে কাজ করে না, ফলে হার্টবিট খুব ধীর (Bradycardia) বা খুব দ্রুত (Tachycardia) হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন এতটাই অনিয়মিত হয়ে যায় যে এটি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।

এছাড়া, হৃদযন্ত্র যদি ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে না পারে, তবে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত হয় না, যার ফলে মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া এবং জ্ঞান হারানোর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় রোগীরা দাঁড়ানোর সময় বা হঠাৎ উঠে পড়লে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন। এটি খুবই বিপজ্জনক, কারণ এতে হঠাৎ পড়ে গিয়ে আঘাত লাগতে পারে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে।

মানসিক উদ্বেগ ও ডিপ্রেশন

শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি হার্টের রোগ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। যারা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের মধ্যে উদ্বেগ (Anxiety) ও বিষণ্নতা (Depression) দেখা দিতে পারে। তারা প্রায়ই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকেন, কারণ হার্টের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী ও জীবনসংকটজনিত হতে পারে।

এছাড়া, অনেক রোগী মনে করেন যে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না, ফলে তারা সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন, বাইরে বের হতে অনীহা দেখান এবং একাকিত্ব বোধ করেন। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ থাকলে তা হৃদরোগের অবস্থা আরও খারাপ করে তুলতে পারে, কারণ এটি রক্তচাপ বাড়ায় এবং স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, যা হৃদযন্ত্রের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে। তাই হৃদরোগীদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে পরিবারের সদস্যদের উচিত তাদের পাশে থাকা এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করা।

উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি

হৃদযন্ত্র যদি ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে না পারে, তবে রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন (Hypertension) ধমনীগুলোকে শক্ত ও সংকুচিত করে ফেলে, যার ফলে হার্টের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এটি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

স্ট্রোক মূলত তখনই ঘটে যখন মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। হার্টের অসুস্থতার কারণে রক্তনালীতে জমাট বাঁধা (Blood Clot) তৈরি হতে পারে, যা মস্তিষ্কে পৌঁছে স্ট্রোক ঘটাতে পারে। স্ট্রোক হলে শরীরের কোনো অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে, এমনকি স্মৃতিশক্তিও কমে যেতে পারে। তাই হৃদরোগীদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস

হৃদরোগের ফলে শরীরে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হলে কিডনি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীরের অতিরিক্ত পানি ও বর্জ্য অপসারণ করা, যা রক্তচলাচলের মাধ্যমে ঘটে। কিন্তু হার্ট ঠিকমতো রক্ত পাম্প না করলে কিডনিতে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছায় না, ফলে এটি কার্যক্ষমতা হারায়।

কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমতে শুরু করে, যা আরও নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। অনেক সময় কিডনি বিকল (Kidney Failure) হয়ে যেতে পারে, যার ফলে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। তাই যারা হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের নিয়মিত কিডনির কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা উচিত এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা দরকার।

স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও ডিমেনশিয়া

হার্ট ঠিকমতো কাজ না করলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয় না, যা দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতিশক্তি হ্রাসের কারণ হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের মধ্যে ডিমেনশিয়া (Dementia) এবং আলঝেইমার (Alzheimer’s disease) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলে দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় রোগীরা সাম্প্রতিক ঘটনা ভুলে যান, নাম-ঠিকানা মনে রাখতে পারেন না বা একই কথা বারবার বলেন। এটি ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। তাই হার্টের যত্ন নেওয়া মানেই স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখা।

ঘুমের ব্যাঘাত ও স্লিপ অ্যাপনিয়া

হার্টের সমস্যা থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং অনেক ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep Apnea) দেখা দেয়। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে রাতে ঘুমানোর সময় শ্বাসপ্রশ্বাস কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এটি ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

যারা স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভুগছেন, তারা ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক নাক ডাকতে পারেন, মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যেতে পারে এবং দিনে চরম ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। দীর্ঘদিন ঘুমের সমস্যা থাকলে হৃদরোগ আরও তীব্র হতে পারে এবং উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। তাই ভালো ঘুম নিশ্চিত করা হার্টের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

খাদ্য হজমে সমস্যা ও গ্যাস্ট্রিকের প্রবণতা বৃদ্ধি

হার্টের সমস্যা থাকলে পরিপাকতন্ত্রেও প্রভাব পড়ে। অনেক সময় ডায়জেস্টিভ ডিজঅর্ডার (Digestive Disorder) দেখা দেয়, যার ফলে খাবার হজম করতে সমস্যা হয়। হজমের সমস্যা থাকলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি শোষণ করতে পারে না, যা আরও দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া, হার্টের সমস্যার কারণে গ্যাস্ট্রিক (Gastric) এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্স (Acid Reflux) এর প্রবণতা বাড়তে পারে। অনেক সময় বুকে জ্বালাপোড়া ও অস্বস্তি হয়, যা হৃদরোগের ব্যথার সঙ্গে মিল থাকতে পারে। অনেক রোগী এই ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিক ভেবে অবহেলা করেন, যা পরে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তাই হজমের সমস্যা দেখা দিলে সেটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা প্রয়োজন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

হার্টের সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক করণীয়

হার্টের সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগ বিশেষত হার্ট অ্যাটাক বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, যা জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। তাই সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। নিচে হার্টের সমস্যার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়গুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

দ্রুত আরামদায়ক অবস্থানে বসা বা শোয়া

যদি কারও বুকের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অস্বস্তি শুরু হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিরাপদ ও আরামদায়ক অবস্থানে বসতে বা শুয়ে পড়তে বলা উচিত। দাঁড়িয়ে থাকলে রক্তচাপের ওঠানামা হতে পারে, যা সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে রোগী যদি শোয়ে পড়ে, তবে শ্বাসকষ্ট কমাতে তাকে একটু কাত হয়ে বা বালিশের সাহায্যে সামান্য উঁচু করে শোয়ানো যেতে পারে। সোজা হয়ে শুয়ে থাকলে ফুসফুসে চাপ পড়তে পারে, যা শ্বাসকষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই রোগীকে স্বস্তিদায়ক ভঙ্গিতে বসিয়ে বা শুইয়ে রেখে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

রোগীকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করা

হার্টের সমস্যা হলে রোগী অনেক সময় অতিরিক্ত শ্বাস নিতে শুরু করেন বা শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো অনুভব করেন। এই অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়ে তাকে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে সহায়তা করতে হবে।

যদি রোগী খুব বেশি দুশ্চিন্তা বা আতঙ্কে ভুগতে থাকেন, তবে তাকে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিতে বলা উচিত। অনেক সময় রোগী যদি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তবে তার হৃদস্পন্দন আরও অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। তাই আশপাশের লোকজনের উচিত রোগীকে আশ্বস্ত করা এবং শান্ত রাখা।

দ্রুত অ্যাসপিরিন বা নিট্রোগ্লিসারিন খাওয়ানো (যদি চিকিৎসকের পরামর্শ থাকে)

যদি রোগীর পূর্ব থেকে হার্টের কোনো সমস্যা থাকে এবং চিকিৎসক তাকে অ্যাসপিরিন (Aspirin) বা নিট্রোগ্লিসারিন (Nitroglycerin) সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তবে দ্রুত এটি খাওয়ানো যেতে পারে।

  • অ্যাসপিরিন: এটি রক্ত পাতলা করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে রক্ত প্রবাহ সচল রাখতে সাহায্য করে। তবে এটি খাওয়ানোর আগে নিশ্চিত হতে হবে যে রোগী এতে অ্যালার্জিক নন।
  • নিট্রোগ্লিসারিন: এটি হার্টের ধমনীগুলো প্রসারিত করতে সাহায্য করে, যা বুকের ব্যথা কমাতে পারে। এটি সাধারণত অ্যাঞ্জাইনা বা করোনারি আর্টারি ডিজিজের রোগীদের দেওয়া হয়।

তবে এই ওষুধগুলোর ব্যবহার শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ থাকলে করা উচিত।

দ্রুত ৯৯৯ (বাংলাদেশে) বা স্থানীয় জরুরি নম্বরে কল করা

যদি রোগীর বুকের ব্যথা ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় বা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া জরুরি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা যেতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে রোগী মনে করতে পারেন যে এটি সামান্য গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা, কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা এবং গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা প্রায় একই রকম অনুভূত হতে পারে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া উচিত।

রোগীকে শক্ত খাবার না দেওয়া এবং প্রচুর পানি পান করানো এড়িয়ে চলা

হার্ট অ্যাটাক বা গুরুতর শ্বাসকষ্টের সময় রোগীকে কোনো ধরনের শক্ত খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। খাবার হজমের জন্য শরীরের রক্ত প্রবাহ পাচনতন্ত্রের দিকে প্রবাহিত হতে পারে, যা হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

এছাড়া, বেশি পানি পান করানোও এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এটি হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। বিশেষ করে, যদি রোগীর হার্ট ফেইলিউর বা এডিমা (শরীরে পানি জমা) থাকে, তবে বেশি তরল গ্রহণ বিপজ্জনক হতে পারে।

রোগীকে খুব বেশি নড়াচড়া করতে না দেওয়া

যদি রোগী হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অনুভব করেন, তবে তাকে খুব বেশি নড়াচড়া করতে নিরুৎসাহিত করা উচিত। অতিরিক্ত নড়াচড়া করলে হৃদপিণ্ড আরও বেশি অক্সিজেনের চাহিদা তৈরি করে, যা সমস্যাকে গুরুতর করে তুলতে পারে।

তাই রোগীকে এক জায়গায় বসিয়ে বা শুইয়ে রেখে চিকিৎসা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভালো। তবে যদি সে একেবারে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে বা শ্বাস নিচ্ছে না বলে মনে হয়, তবে সিপিআর (CPR) শুরু করার প্রয়োজন হতে পারে।

সিপিআর (CPR) প্রয়োগ করা (প্রয়োজনে)

যদি রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় এবং শ্বাস নিচ্ছে না, তাহলে দ্রুত সিপিআর (Cardiopulmonary Resuscitation) প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এটি এমন একটি জরুরি পদ্ধতি, যা হার্ট বন্ধ হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচানোর সম্ভাবনা বাড়ায়।

  • প্রথমে রোগীর বুকের মাঝখানে দুই হাত রেখে ১০০-১২০ বার প্রতি মিনিটে চাপ দিন।
  • যদি প্রশিক্ষিত কেউ থাকেন, তবে মুখে-মুখে শ্বাস দেওয়ার (Mouth-to-Mouth Resuscitation) পদ্ধতিও প্রয়োগ করতে পারেন।
  • যতক্ষণ না পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা আসে, ততক্ষণ এটি চালিয়ে যেতে হবে।

তবে সিপিআর প্রয়োগের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে রোগী সত্যিই শ্বাস নিচ্ছে না বা নড়াচড়া করছে না।

রোগীকে মানসিকভাবে স্বস্তি দেওয়া ও আতঙ্ক কমানো

হার্টের সমস্যা দেখা দিলে রোগী আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন, যা হৃদযন্ত্রের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে। তাই আশপাশের লোকদের উচিত তাকে মানসিকভাবে শান্ত রাখা এবং ভীত না হতে বলা।

রোগীকে আশ্বস্ত করতে বলা যেতে পারে—

“সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা কোরো না। আমরা ডাক্তার আনছি।”

এই ধরনের ইতিবাচক কথাবার্তা রোগীর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে, যা হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করবে।

উপসংহার

আমাদের প্রত্যেকের হার্ট নিঃশব্দে এবং নিরলসভাবে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে চলেছে -এক মুহূর্তের জন্যও এটি বিশ্রাম নেয় না। একটু বুকে হাত দিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন আপনার হার্ট আপনার জন্য প্রতিনিয়ত কতটা পরিশ্রম করে চলেছে। অথচ, আমরা কি তার প্রতি ন্যূনতম যত্ন নিচ্ছি? অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ -এসবই ধীরে ধীরে আমাদের হার্টকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু সুখবর হলো, সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ৮০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব! তাই নিয়মিত ব্যায়াম করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, মানসিক চাপ কমান। মনে রাখবেন, আপনার হার্ট সুস্থ থাকলেই কেবল সুস্থ থাকবেন আপনি। অন্যথায় নয়! ধন্যবাদ।

Related posts

Leave a Comment