আপনি কি জানেন, মাত্র কয়েক মিনিটের চিকিৎসাই একটি জটিল রোগ থেকে আপনার প্রাণ রক্ষা করতে পারে? বিশ্বের প্রতি চারজন মৃত্যুর মধ্যে একজন মারা যায় হৃদরোগে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ হৃদরোগজনিত জটিলতায় প্রাণ হারায়। অথচ এই ভয়াবহ চিত্রের মাঝেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার – “স্টেন্টিং বা রক্তনালিতে রিং স্থাপন” পদ্ধতি – লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে। এক সময় হৃদরোগের চিকিৎসা মানেই ছিল খোলা হার্ট সার্জারি, দীর্ঘ পুনর্বাসন এবং উচ্চ ঝুঁকি। কিন্তু এখন, আধুনিক স্টেন্টিং পদ্ধতিতে মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন! এই চিকিৎসা প্রযুক্তি শুধু সময় ও খরচই বাঁচায় না, বরং জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ উপায় হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
স্টেন্টিং বা রক্তনালিতে রিং স্থাপন পদ্ধতিটি মূলত হৃদযন্ত্রে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে তা পুনরায় সচল করার এক আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি। একটি সূক্ষ্ম ধাতব রিং (স্টেন্ট) ছোট্ট একটি বেলুনের সাহায্যে সংকুচিত অংশে স্থাপন করে রক্তনালিকে খোলাভাব দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ স্টেন্ট স্থাপন করা হয় – যা হৃদরোগ চিকিৎসায় এই প্রযুক্তির গুরুত্ব প্রমাণ করে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর প্রায় ২৫,০০০ রোগীর শরীরে স্টেন্ট স্থাপন করা হচ্ছে, এবং সংখ্যাটি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ড্রাগ এলুটিং স্টেন্ট নামের নতুন প্রজন্মের রিংগুলো ৯৫% পর্যন্ত পুনরায় ব্লক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে এনেছে! এতসব তথ্য জেনে নিশ্চয়ই আপনি ভাবছেন, আপনার বা প্রিয়জনের জন্য স্টেন্টিং কি উপযুক্ত সমাধান? তবে চলুন জেনে নিই, স্টেন্টিং বা রক্তনালিতে রিং স্থাপন চিকিৎসা সম্পর্কে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহ।
হার্ট অ্যাটাক আর মৃত্যুর ভয়: সমাধান কি স্টেন্টিং?
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আতঙ্কজনক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর একটি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, মানসিক চাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো কারণগুলো হৃদযন্ত্রের ধমনীতে চর্বি জমিয়ে ব্লক সৃষ্টি করে। এই ব্লকই হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ। যখন হঠাৎ ধমনী পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তখন হৃদযন্ত্র পর্যাপ্ত রক্ত পায় না, ফলে হঠাৎ করেই ঘটে যেতে পারে মৃত্যুঝুঁকি। তাই সময়মতো রোগ নির্ণয় ও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ জীবন বাঁচাতে পারে।
স্টেন্টিং হলো হৃদযন্ত্রের বন্ধ ধমনীতে একটি বিশেষ ধাতব নল (স্টেন্ট) স্থাপন করে রক্ত চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখা। এটি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং বর্তমানে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে এক অত্যন্ত কার্যকর ও সাধারণ পদ্ধতি। তবে এটি চূড়ান্ত সমাধান নয়- স্টেন্ট বসানোর পরও রোগীকে জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হয়, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, এবং সঠিক ডায়েট ও ব্যায়াম মেনে চলতে হয়। তাই স্টেন্টিং জীবন বাঁচাতে পারে বটে, তবে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় নয়; বরং সচেতন জীবনযাপনই এর প্রকৃত সমাধান।
স্টেন্টিং কী? কিভাবে কাজ করে রিং স্থাপন পদ্ধতি
স্টেন্টিং বা রিং স্থাপন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে হৃদপিণ্ডের ব্লক হয়ে যাওয়া ধমনীতে ধাতব বা ওষুধ-লেপা একটি ছোট জালাকৃতির নল (স্টেন্ট) প্রবেশ করিয়ে স্থাপন করা হয়। এটি ধমনীকে প্রসারিত করে রক্ত চলাচলের পথ খুলে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে রোগীর কুঁচকি বা হাতে একটি টিউব ঢুকিয়ে ক্যাথেটারের মাধ্যমে ধমনীতে প্রবেশ করানো হয় এবং ব্লকের স্থানে একটি বেলুন ফোলানো হয়। বেলুনের সঙ্গে থাকা স্টেন্ট ধমনীকে চেপে প্রসারিত করে এবং পরে বেলুন সরিয়ে ফেলা হলেও স্টেন্ট ধমনীতে স্থায়ীভাবে থেকে যায়, যা রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে ও পরবর্তী হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।

স্টেন্টের গঠন ও প্রকারভেদ
স্টেন্ট একটি ছোট, জালাকৃতির নল বা রিং যা সাধারণত স্টেইনলেস স্টিল বা কেবল-ধাতব মিশ্রণ দিয়ে তৈরি হয়। এটি নমনীয় এবং সংকুচিত অবস্থায় ধমনীতে প্রবেশ করিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা হয়। স্টেন্ট দুই প্রকার- বেয়ার মেটাল স্টেন্ট (BMS) ও ড্রাগ এলুটিং স্টেন্ট (DES)। BMS শুধুমাত্র ধাতব উপাদানে তৈরি এবং ধমনীকে খোলা রাখতে কাজ করে। অপরদিকে, DES স্টেন্টে ওষুধের প্রলেপ থাকে যা ধমনীর মধ্যে কোষ বৃদ্ধিকে ধীর করে, ফলে পুনরায় ব্লক হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। সাম্প্রতিককালে বায়োঅ্যাবজর্ভেবল স্টেন্টও ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে শরীরের ভিতরে বিলীন হয়ে যায়।
রক্তনালিতে স্টেন্ট বসানোর ধাপগুলো
স্টেন্ট বসানোর প্রক্রিয়াকে ‘পারকুটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (PCI)’ বলা হয়। প্রথমে রোগীকে সেডেটিভ ও লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়। এরপর ক্যাথেটারের মাধ্যমে হাতে বা কুঁচকির ধমনী দিয়ে একটি গাইড ওয়্যার প্রবেশ করানো হয় যা ধমনীর ব্লক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একটি ছোট বেলুন ও তার চারপাশে সংকুচিত স্টেন্টসহ ক্যাথেটার ব্লক স্থানে পৌঁছায়। বেলুন ফোলালে স্টেন্ট প্রসারিত হয়ে ধমনীর দেয়ালে বসে যায়। পরে বেলুন ও ক্যাথেটার সরিয়ে ফেলা হয়, এবং স্টেন্ট ধমনীর ভেতর স্থায়ীভাবে থেকে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে।
বেলুন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বনাম স্টেন্টিং
বেলুন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্লক হয়ে যাওয়া ধমনীতে একটি ক্ষুদ্র বেলুন ঢুকিয়ে ফোলানো হয়, যাতে রক্তনালিটি প্রসারিত হয় এবং রক্ত চলাচল সহজ হয়। তবে এতে ধমনী পুনরায় সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে, স্টেন্টিং হলো অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরবর্তী ধাপ, যেখানে একটি স্টেন্ট স্থাপন করে ধমনীর প্রসারিত অবস্থা স্থায়ী করা হয়। স্টেন্ট রক্তনালিকে চেপে ধরে রাখে, ফলে ধমনীর পুনরায় ব্লক হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। তাই তুলনামূলকভাবে স্টেন্টিং দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেয়, যদিও খরচ কিছুটা বেশি হতে পারে।
কেন স্টেন্টিং এত জনপ্রিয়?
সময় ও খরচে কম, ফলাফলে উন্নত
স্টেন্টিং বর্তমানে এত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এটি তুলনামূলকভাবে দ্রুত, কম খরচে সম্পন্নযোগ্য এবং অধিক কার্যকর। ঐতিহ্যবাহী বাইপাস সার্জারির তুলনায় এই পদ্ধতিতে সময় লাগে কম, হাসপাতালে থাকার দিনসংখ্যাও কম হয়। অনেক ক্ষেত্রেই একই দিনে রোগী বাসায় ফিরতে পারেন। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে এখন স্টেন্টিংয়ের সাফল্যের হারও অনেক বেশি, ফলে রোগীরা দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তি পান এবং কাজের সক্ষমতা দ্রুত ফিরে পান।
অপারেশন ছাড়া চিকিৎসার সুবিধা
স্টেন্টিং একটি নন-সার্জিক্যাল বা অপ্রচলিত অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যার ফলে রোগীর শরীরে বড় কোনো কাটা বা টানার প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র কুঁচকি বা হাতে একটি ছোট ছিদ্র করেই এই চিকিৎসা সম্ভব। ফলে প্রচলিত অপারেশনের সঙ্গে থাকা রক্তক্ষয়, সংক্রমণ বা জটিলতার ঝুঁকি অনেক কম থাকে। এই কারণেই উচ্চ বয়সের বা ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জন্যও স্টেন্টিং একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
দ্রুত সুস্থতা ও কম পুনরায় ভর্তি হওয়ার হার
স্টেন্টিংয়ের পর রোগীরা খুব দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেন। সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই রোগী হাঁটা-চলা শুরু করতে পারেন এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই হালকা কাজকর্মে ফিরতে পারেন। ওষুধ ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে স্টেন্ট কার্যকরভাবে ধমনী খোলা রাখে, ফলে ব্লক পুনরায় হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। এর ফলে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, উচ্চ চিকিৎসা খরচ ও মানসিক চাপ- সবই অনেকটাই হ্রাস পায়।
কতটা নিরাপদ এই পদ্ধতি?
স্টেন্টিং সাধারণভাবে একটি নিরাপদ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি হলেও, এর কিছু ঝুঁকি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন রক্তনালিতে ক্ষত, রক্তক্ষরণ, এলার্জিক প্রতিক্রিয়া, অথবা স্টেন্ট বসানোর স্থানে রক্ত জমাট বাঁধা (থ্রম্বোসিস)। তবে এসব ঝুঁকি অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য যদি রোগী চিকিৎসা পরবর্তী নিয়ম মেনে চলে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করে। আধুনিক ড্রাগ-এলুটিং স্টেন্ট (DES) পুরনো বেয়ার মেটাল স্টেন্টের (BMS) তুলনায় অনেক উন্নত, কারণ এতে থাকা ওষুধ ধমনীতে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধ করে, ফলে স্টেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। চিকিৎসা পরবর্তী যত্ন এই পদ্ধতির সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- স্টেন্ট বসানোর পর নিয়মিত ব্লাড থিনার ও অন্যান্য ওষুধ সঠিক সময় ও মাত্রায় গ্রহণ করতে হয়, যাতে রক্ত জমাট না বাঁধে এবং ধমনীর মধ্যে স্টেন্ট দীর্ঘসময় কার্যকর থাকে। সেই সঙ্গে ডায়েট নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান বর্জন, হালকা ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করাও সমানভাবে জরুরি। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্টেন্টিং যতটা কার্যকর, ততটাই নিরাপদ- যদি সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া হয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা হয়।
বাংলাদেশে স্টেন্টিংয়ের বর্তমান অবস্থা ও ব্যয়
গড় খরচ কত?
বাংলাদেশে স্টেন্টিংয়ের খরচ স্টেন্টের ধরণ, হাসপাতালের ধরন এবং অন্যান্য চিকিৎসা সেবার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত, উন্নত মানের ড্রাগ-এলুটিং স্টেন্টের দাম ৬৩,০০০ থেকে ১,৪০,৫০০ টাকার মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে । তবে, সম্পূর্ণ স্টেন্টিং প্রক্রিয়ার খরচ, যা এনজিওগ্রাম, হাসপাতাল ভর্তি, ওষুধ এবং অন্যান্য সেবাসহ, ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে । দেশ রূপান্তর
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের পার্থক্য
সরকারি হাসপাতালগুলোতে, যেমন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, স্টেন্টিংয়ের খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই হাসপাতালে স্টেন্টিংয়ের গড় খরচ প্রায় ৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে । অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একই সেবার খরচ অনেক বেশি, যা অনেক সময় ৩ থেকে ৫ লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে । bnttp.net
স্বাস্থ্যবিমা বা কার্ড ব্যবহারের সুযোগ
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থা এখনও পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি, ফলে অধিকাংশ রোগীকেই চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ নিজেই বহন করতে হয় । তবে, কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যেমন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের জন্য, সরকার হেলথ কার্ড প্রদান করছে, যার মাধ্যমে তারা সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন । দেশ রূপান্তরNews Bangla 24
স্টেন্টিং নাকি বাইপাস সার্জারি?
স্টেন্টিং ও বাইপাস সার্জারি- উভয়ই হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি হলেও এদের উদ্দেশ্য, প্রয়োগের ক্ষেত্র এবং জটিলতা ভিন্ন। স্টেন্টিং হল নন-সার্জিক্যাল, দ্রুত এবং তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ একটি পদ্ধতি, যেখানে ব্লক ধমনিতে একটি ছোট ধাতব নল (স্টেন্ট) বসিয়ে রক্ত চলাচলের পথ খুলে দেওয়া হয়। এটি সাধারণত এক বা দুইটি ব্লকেজে কার্যকর এবং কম সময়ে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে, বাইপাস সার্জারি একটি পূর্ণাঙ্গ ওপেন-হার্ট সার্জারি, যেখানে শরীরের অন্য কোনো অংশের রক্তনালিকে ব্লক ধমনীকে বাইপাস করতে বসানো হয়। এটি অনেক বেশি জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ, তবে একাধিক জটিল বা গুরুতর ব্লকেজের ক্ষেত্রে এটি বেশি কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দেয়। যাদের ডায়াবেটিস, একাধিক আর্টারিতে ব্লক বা পূর্বে স্টেন্ট ব্যর্থ হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারি অধিক নিরাপদ। অপরদিকে, যাদের ঝুঁকি কম বা এক/দুইটি ব্লক রয়েছে, তাদের জন্য স্টেন্টিংই যথেষ্ট। তাই কোনটি বেছে নেবেন, তা নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা, ব্লকেজের ধরন, এবং চিকিৎসকের পরামর্শের উপর। সঠিক নির্ণয় ও সময়োচিত সিদ্ধান্তই হতে পারে প্রাণ বাঁচানোর চাবিকাঠি।
স্টেন্ট বসানোর পর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা
স্টেন্ট বসানোর পর হৃদযন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমেই চর্বি ও কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার যেমন গরু বা খাসির মাংস, ঘি, বাটার, ট্রান্সফ্যাট ও ফাস্টফুড পরিহার করা উচিত। এসব খাবার ধমনীতে পুনরায় চর্বি জমার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়, যা স্টেন্ট ফেলিওরের কারণ হতে পারে। পরিবর্তে খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে প্রচুর শাকসবজি, আঁশযুক্ত ফলমূল (যেমন আপেল, কমলা, পেয়ারা), ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ (যেমন রুই, কাতলা, স্যামন), বাদাম, এবং পূর্ণ শস্য (whole grains)। প্রতিদিন পরিমিত পানি পান ও লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি, বিশেষ করে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে। এছাড়া ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস স্টেন্ট বসানোর সুফল নষ্ট করে দিতে পারে, তাই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদের পরামর্শমাফিক একটি হৃদবান্ধব খাদ্যতালিকা অনুসরণ করাই সবচেয়ে নিরাপদ।
খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি জীবনধারার পরিবর্তনও স্টেন্টিংয়ের সফলতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম গ্রহণের পর ধীরে ধীরে হালকা শরীরচর্চা যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম বা হালকা স্ট্রেচিং শুরু করা উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম ধমনীতে রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখে এবং হৃদপিণ্ডকে সক্রিয় রাখে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং গ্রহণ করতে হবে, কারণ মানসিক অস্থিরতা রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, ওষুধ গ্রহণের নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলা জরুরি- বিশেষ করে ব্লাড থিনার বা রক্ত পাতলা রাখার ওষুধ নির্ধারিত সময়মতো গ্রহণ করতে হবে। ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা, ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং নিয়মিত ফলোআপ করানো এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস। সর্বোপরি, স্টেন্ট বসানোর পর জীবনযাত্রার প্রতিটি দিকেই সচেতন ও নিয়ন্ত্রিত হতে পারলেই দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
উপসংহার
হৃদরোগের চিকিৎসায় স্টেন্টিং বা রক্তনালিতে রিং স্থাপন শুধু প্রযুক্তিগত একটি অগ্রগতিই নয়, এটি বর্তমানে মানবজীবনের রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ আবার ফিরে পেয়েছে তাদের স্বাভাবিক জীবন, কর্মক্ষমতা এবং জীবনের প্রতি বিশ্বাস। স্টেন্টিং যতটা দ্রুত ও কার্যকর, ততটাই কম ঝুঁকিপূর্ণ – বিশেষ করে যদি সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে এও মনে রাখা দরকার, স্টেন্ট স্থাপন শেষ কথা নয়; পরবর্তী জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত চিকিৎসক পরামর্শ গ্রহণই হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল চাবিকাঠি। তাই নিজের ও প্রিয়জনের হার্টের সুস্থতার কথা চিন্তা করে, সচেতন হন, নিয়মিত পরীক্ষা করান, এবং প্রয়োজনে এই আধুনিক পদ্ধতির সহায়তা নিন – কারণ একটুখানি যত্নই হতে পারে আপনার জীবন রক্ষাকারী সিদ্ধান্ত।