আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে হার্ট অন্যতম। প্রতিদিন প্রায় এক লাখবার ধকধক করে এটি আমাদের সারা শরীরে রক্ত পৌঁছে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঘরে বসে হার্ট ভালো আছে কি করে বুঝবো? হার্টের সুস্থতা নিয়ে চিন্তা করা শুধু বয়স্কদের জন্য নয়; বরং যেকোনো বয়সেই এটি জানা জরুরি। অনেকেই হার্টের সমস্যা সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না, কারণ হার্টের অসুস্থতা অনেক সময় নীরবে শরীরের ভেতরে কাজ করে।
তবে ভালো খবর হলো, কিছু সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে ঘরে বসেই আপনি আপনার হার্টের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন নেই কোনো বিশেষ যন্ত্রপাতির। বরং সামান্য সচেতনতা ও কিছু শারীরিক লক্ষণের পর্যবেক্ষণ করলেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার হৃদপিণ্ড কেমন কাজ করছে। আজ আমরা জানবো ঘরে বসে হার্ট ভালো আছে কি করে বুঝবো? গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের আজকের আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
হার্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে হার্ট অন্যতম। এটি একটি পেশল অঙ্গ যা রক্ত পাম্প করে এবং পুরো শরীরে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করে। প্রতিনিয়ত হার্ট আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালন করে, যাতে প্রতিটি কোষ পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় এবং বর্জ্য পদার্থ যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড দেহ থেকে বের হয়ে যেতে পারে। যদি হার্ট ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, কিডনি, ও যকৃৎ সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। তাই হার্ট সুস্থ না থাকলে শরীরের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্ট কেবল রক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেই আমাদের সুস্থ রাখে না, বরং এটি দেহের রক্তচাপ ও হার্টবিটও নিয়ন্ত্রণ করে। হার্ট যদি দুর্বল হয়ে যায় বা ব্লকেজ তৈরি হয়, তাহলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। হার্ট সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। সুস্থ হার্ট মানেই সুস্থ জীবন, কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সহজ করে তোলে এবং দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
হার্টের সুস্থতা জানা কেন জরুরি?
হার্ট সুস্থ আছে কিনা তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক সময় হার্টের রোগের লক্ষণগুলো সহজে বোঝা যায় না। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, কিংবা ক্ষীণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো লক্ষণ ধীরে ধীরে মারাত্মক হৃদরোগের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, হার্টের রোগ নীরবে শরীরে বাসা বাঁধে এবং একসময় তা মারাত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। নিয়মিত হার্ট চেকআপের মাধ্যমে রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা, ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রামের মতো পরীক্ষার সাহায্যে হার্টের বর্তমান অবস্থা জানা সম্ভব, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে।
হার্টের সুস্থতা সম্পর্কে জানা গেলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পরিকল্পনা করা সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারও পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে হবে এবং খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। ধূমপান, অতিরিক্ত চর্বি ও লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং মানসিক চাপ হার্টের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যা আগেভাগে জানা থাকলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। সুতরাং, দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য হার্টের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ঘরে বসে হার্ট ভালো আছে কি করে বুঝবো?
হার্ট আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা প্রতিনিয়ত রক্ত পাম্প করে সারা শরীরে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই হার্ট ভালো আছে কিনা, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কি শুধু হাসপাতালে গিয়েই হার্টের অবস্থা বোঝা সম্ভব? না, কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করলেই ঘরে বসে হার্ট ভালো আছে কি করে বুঝবো? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, হার্ট রেট পরীক্ষা করা একটি কার্যকর পদ্ধতি। একজন সুস্থ মানুষের হার্ট রেট প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বিট হওয়া উচিত, যা গলার ধমনিতে বা কবজির শিরায় স্পন্দন অনুভব করে সহজেই মাপা যায়। দ্বিতীয়ত, রক্তচাপ মাপা জরুরি, কারণ উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপ হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ব্লাড প্রেসার মেশিন ব্যবহার করে ঘরে বসেই এটি পরীক্ষা করা সম্ভব। তৃতীয়ত, শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। যদি সামান্য পরিশ্রমেই শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা বুক ধড়ফড় করে, তবে এটি হার্টের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
এছাড়া, ব্যায়ামের পর শরীর কত দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, সেটিও হার্টের কার্যক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। সুস্থ হার্ট হলে ব্যায়ামের পর ১-৩ মিনিটের মধ্যেই হার্ট রেট স্বাভাবিক হয়ে আসার কথা। তাছাড়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি, বুকে ব্যথা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, অথবা অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫%-এর নিচে নামা—এই ধরনের লক্ষণ থাকলে সতর্ক হওয়া জরুরি। ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসা বা বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া (স্লিপ অ্যাপনিয়া) থাকলেও এটি হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হার্টের অবস্থা বোঝা সম্ভব এবং যদি কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সুস্থ জীবনধারা অনুসরণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হার্ট ভালো রাখা সম্ভব, যা আমাদের দীর্ঘায়ু ও সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি।

হার্টের সুস্থতার লক্ষণসমূহ কি কি?
সুস্থ হার্ট মানেই দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবন। হার্টের ভালো থাকা বোঝার কিছু নির্দিষ্ট উপায় আছে, যা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যায়। নিচে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ আলোচনা করা হলো, যা নির্দেশ করে যে আপনার হার্ট সুস্থভাবে কাজ করছে।
স্থিতিশীল রক্তচাপ
সুস্থ হার্টের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো স্থিতিশীল রক্তচাপ। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ হওয়া উচিত ১২০/৮০ mmHg। রক্তচাপ বেশি হলে এটি উচ্চ রক্তচাপের (Hypertension) লক্ষণ এবং কম হলে নিম্ন রক্তচাপের (Hypotension) লক্ষণ হতে পারে, যা উভয়ই হার্টের জন্য ক্ষতিকর। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা এবং তা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অস্বাভাবিক রক্তচাপ দীর্ঘমেয়াদে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যদি রক্তচাপ দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক থাকে, তাহলে এটি নির্দেশ করে যে হার্ট ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করছে এবং রক্তনালীতে কোনো বাধা নেই। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান, ও মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ বা নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা সম্পর্কে অবগত নন, তাই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি। স্থিতিশীল রক্তচাপ মানেই সুস্থ হার্ট এবং সুস্থ দেহ।
স্বাভাবিক হার্টবিট বা পালস রেট
সুস্থ হার্টের আরেকটি লক্ষণ হলো স্বাভাবিক পালস রেট বা হার্টবিট। সাধারণত একজন সুস্থ মানুষের বিশ্রামের সময় হার্টবিট প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বিট হওয়া উচিত। যদি হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত বা ধীর হয়, তাহলে এটি হার্টের অসুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে। উচ্চ হার্টবিট (Tachycardia) হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, আর খুব কম হার্টবিট (Bradycardia) শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে।
নিয়মিত পালস রেট পরীক্ষা করা জরুরি, বিশেষ করে যদি আপনি ক্লান্তি, মাথা ঘোরা বা শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করলে স্বাভাবিক হার্টবিট বজায় রাখা সহজ হয়। হার্টবিটের স্থিতিশীলতা মানে হলো হার্ট স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে এবং কোনো গুরুতর সমস্যা নেই।
পর্যাপ্ত শারীরিক সহনশীলতা ও শক্তি
যদি আপনি সহজেই পরিশ্রম করতে পারেন এবং তাড়াতাড়ি ক্লান্ত না হন, তাহলে এটি আপনার হার্টের সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে। সুস্থ হার্ট কার্যকরভাবে শরীরে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে, যার ফলে পেশী ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহজে কাজ করতে পারে। যারা সামান্য কাজ করলেই হাঁপিয়ে ওঠেন বা অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করেন, তাদের হার্ট দুর্বল হতে পারে এবং অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষা করতে আপনি হাঁটা, দৌড়ানো বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মতো সাধারণ কাজ করতে পারেন। যদি এসব কাজ করার সময় কোনো অস্বস্তি না হয়, তাহলে এটি সুস্থ হার্টের লক্ষণ। নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করে।
পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা
সুস্থ হার্ট শরীরের প্রতিটি কোষে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। যদি আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে এবং সামান্য পরিশ্রম করলেও শ্বাসকষ্ট অনুভূত না হয়, তাহলে এটি হার্টের ভালো থাকার লক্ষণ। যাদের হার্ট দুর্বল বা কোনো সমস্যাযুক্ত, তারা সাধারণত হাঁটাহাঁটি বা হালকা পরিশ্রমের সময়ই শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন, যা হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
যদি আপনি গভীরভাবে শ্বাস নিতে পারেন এবং শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে, তাহলে এটি হার্টের কার্যকারিতার একটি ভালো দিক। ধূমপান, দূষণ, ওজন বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার ফলে ফুসফুস ও হার্টের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে, তাই সুস্থ শ্বাস-প্রশ্বাস নিশ্চিত করতে নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
মানসিক প্রশান্তি ও পর্যাপ্ত ঘুম
সুস্থ হার্ট শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যারা মানসিকভাবে শান্ত এবং পর্যাপ্ত ঘুম পান, তাদের হার্ট সাধারণত সুস্থ থাকে। অনিদ্রা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ সরাসরি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্রেসের ফলে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা রক্তচাপ ও হার্টবিট বাড়িয়ে হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
যদি আপনি প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম পান এবং সকালে সতেজ অনুভব করেন, তাহলে এটি হার্টের সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে। মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখতে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো অত্যন্ত কার্যকর। পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করলে হার্ট সুস্থ থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
হার্টের সুস্থতা বুঝতে হলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মেনে চলা এবং শরীরের পরিবর্তনগুলোর প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। স্থিতিশীল রক্তচাপ, স্বাভাবিক হার্টবিট, শারীরিক সহনশীলতা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ, ও মানসিক প্রশান্তি—এগুলোই হার্টের ভালো থাকার প্রধান লক্ষণ। সুস্থ হার্ট মানেই দীর্ঘ ও আনন্দময় জীবন, তাই হার্টের যত্ন নেওয়া আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়মিত হার্ট চেকআপ প্রয়োজন কেন?
হার্ট সুস্থ আছে কিনা তা জানার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। অনেক সময় হৃদরোগের লক্ষণগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না এবং যখন সমস্যা প্রকাশ পায়, তখন তা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল জমা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। নিয়মিত হার্ট চেকআপের মাধ্যমে ইসিজি (ECG), ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram), ব্লাড প্রেসার মাপা, কোলেস্টেরল পরীক্ষা এবং অন্যান্য জরুরি পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে হার্টের সমস্যা শনাক্ত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক চাপের কারণে হৃদরোগের সমস্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা যেমন—অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, ধূমপান, অ্যালকোহল পান বা নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব হার্টের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিয়মিত চেকআপ করলে ডাক্তার হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন এবং প্রয়োজনে জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। বিশেষ করে, যদি পরিবারে কারও হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সময়মতো হার্টের যত্ন নিলে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন সম্ভব হয়। তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত চেকআপ করানো অত্যন্ত জরুরি।
দৈনন্দিন কিছু লক্ষণ যা হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে
হার্টের সমস্যা অনেক সময় ধীরে ধীরে শরীরে লক্ষণ প্রকাশ করে, যা আমরা সাধারণ ক্লান্তি বা অন্য কোনো সমস্যার কারণ বলে এড়িয়ে যাই। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা অবহেলা করলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। নিচে এমন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা
বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি হৃদরোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। অনেক সময় এটি হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যদি ব্যথাটি বুকে ভারী চাপ, পোড়ার অনুভূতি বা সংকোচনের মতো অনুভূত হয় এবং তা কয়েক মিনিট ধরে স্থায়ী হয়, তবে এটি হার্টের সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকের মাঝখানে বা বাঁ দিকে ব্যথা অনুভূত হয়, যা হাত, গলা, পিঠ বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো এটি অ্যাসিডিটির মতো মনে হতে পারে, তবে যদি বিশ্রাম নেয়ার পরেও ব্যথা না কমে বা শরীর ঠান্ডা ঘামতে শুরু করে, তাহলে তা অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণের সংকেত দেয়।
তবে সব ধরনের বুকে ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নয়। পেশির টান, অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা ফুসফুসের সমস্যার কারণেও বুকে ব্যথা হতে পারে। তবে যদি ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া বা অস্বাভাবিক দুর্বলতা দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত। হার্টের ধমনীগুলোতে ব্লকেজ তৈরি হলে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা এনজাইনা (Angina) নামে পরিচিত ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব হার্ট চেকআপ করানোই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।
অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং দুর্বলতা
অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা দুর্বলতা হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে। যদি স্বাভাবিক কাজকর্ম যেমন হাঁটা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা দৈনন্দিন সাধারণ কাজ করতে গেলেও শরীর অবসাদগ্রস্ত মনে হয়, তাহলে এটি হার্টের দুর্বলতার ইঙ্গিত হতে পারে। সাধারণত হৃদপিণ্ড যখন ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
হার্টের কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরে রক্ত চলাচল ধীরগতিতে হয় এবং শরীরের টিস্যুগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি পায় না। বিশেষ করে, যদি বিশ্রাম নেয়ার পরেও ক্লান্তি অনুভূত হয় বা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই শরীর দুর্বল লাগে, তাহলে এটি হার্টের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়, কারণ তাদের মধ্যে হৃদরোগের লক্ষণ পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে। যদি ক্লান্তির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ বা মাথা ঘোরা দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
হাত-পা ঠান্ডা থাকা বা ফোলা
হাত-পা ঠান্ডা থাকা বা ফুলে যাওয়া রক্ত সঞ্চালনজনিত সমস্যার লক্ষণ হতে পারে, যা হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। সুস্থ হার্ট শরীরের প্রতিটি অংশে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করে। কিন্তু যখন হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে যায় বা রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়, তখন হাত ও পায়ের দিকে রক্তপ্রবাহ কমে যায়, ফলে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে। সাধারণত যাদের হার্ট ফেইলিউর বা ধমনীগুলোর সংকোচনজনিত সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।
শুধু হাত-পা ঠান্ডা নয়, যদি শরীরের নিচের অংশ বিশেষ করে পা, গোড়ালি বা হাত অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়, তাহলে এটি হার্ট ফেইলিউরের লক্ষণ হতে পারে। হৃদপিণ্ড যখন ঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন শরীরে অতিরিক্ত তরল জমতে শুরু করে, যা এডিমা (Edema) সৃষ্টি করে। পায়ের ফোলাভাব দীর্ঘসময় থাকলে এবং চাপ দিলে দেবে যায় বা ব্যথা অনুভূত হয়, তাহলে এটি অবশ্যই হার্টের সমস্যা হতে পারে। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো জরুরি, কারণ এটি অবহেলা করলে ভবিষ্যতে গুরুতর হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
উপসংহার
আমাদের শরীরের সবচেয়ে নিরব অথচ সবচেয়ে কর্মঠ অঙ্গটি হলো হার্ট। এটি এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নেয় না। কেননা এক মুহুর্ত থেমে থাকলেই আমাদের শরীরে কি ঘটতে পারে, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। তাই এর প্রতি যত্নশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আমরা হার্টের সমস্যাকে অবহেলা করি, কিন্তু এটি মারাত্মক হতে পারে। তাই ঘরে বসে হার্ট ভালো আছে কি করে বুঝবো?—এটি জানা আমাদের প্রত্যেকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
সুস্থ হার্ট মানেই সুস্থ জীবন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করতে পারলে হার্ট সুস্থ রাখা সম্ভব। তবে যদি কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হওয়া এবং সময়মতো হার্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। আপনার হার্ট ভালো আছে কি না, এখনই পরীক্ষা করুন এবং সুস্থ থাকুন! ধন্যবাদ।