একটি সুস্থ সকাল হঠাৎ বিষাদের ঘন মেঘে ঢেকে যেতে কতক্ষণ লাগে জানেন? মাত্র কয়েক সেকেন্ড। চলতে থাকা ব্যস্ত জীবনে, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক যেন নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ হার্ট সংক্রান্ত রোগে মারা যান, যার বড় একটি অংশ মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের শিকার। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো- অনেক সময় কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়া হঠাৎ করেই মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ঘটে যেতে পারে!
বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আধুনিক জীবনযাত্রার স্ট্রেস, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান এবং শরীরচর্চার অভাব এই পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। গবেষণা বলছে, ৪০ বছরের নিচে তরুণদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের হার আগের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে! তাই এখনই সময়, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন কী, কেন হয় এবং এর প্রতিকার কিভাবে করা যায়, তা নিয়ে সচেতন হওয়ার।
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন কী?
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, সাধারণভাবে যাকে হার্ট অ্যাটাক বলা হয়, এটি এমন একটি মারাত্মক অবস্থা যেখানে হৃদপিণ্ডের পেশীর (myocardium) কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ঐ অংশটি অক্সিজেনের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যায়। সাধারণত, করোনারি ধমনীতে (coronary artery) জমে থাকা চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থের দ্বারা গঠিত একটি প্লাক ফেটে গেলে বা ছিঁড়ে গেলে সেখানে রক্ত জমাট (thrombus) বাঁধতে পারে এবং ধমনীটি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই রক্ত সরবরাহের ব্যাঘাত যদি দ্রুত পুনরুদ্ধার না করা হয়, তাহলে হৃদপিণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জীবনঘাতী জটিলতা, যেমন হার্ট ফেইলিউর বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে বুকে তীব্র ব্যথা বা চাপ অনুভব করা, যা হাত, ঘাড়, পিঠ, বা চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে, শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডা ঘাম, বমি বমি ভাব বা হঠাৎ দুর্বল অনুভব হওয়া।
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মানসিক চাপ এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নির্ণয়ের জন্য ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG), ট্রোপোনিন রক্ত পরীক্ষা এবং করোনারি এনজিওগ্রাফির মতো বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত করা হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য দ্রুত রক্ত প্রবাহ পুনরুদ্ধার করা, যাতে হৃদপিণ্ডের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অংশের পরিমাণ কমানো যায়। এজন্য থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি (রক্ত জমাট গলানোর ওষুধ), অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি (ধমনীতে স্টেন্ট বসানো) অথবা বাইপাস সার্জারি ব্যবহার করা হয়। হার্ট অ্যাটাকের পর জীবনধারায় পরিবর্তন, যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, ধূমপান পরিহার এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ সেবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যথাসময়ে চিকিৎসা ও সচেতনতা হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক এবং মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের পার্থক্য
হার্ট অ্যাটাক এবং মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction) – এই দুটি শব্দ প্রায়ই একে অপরের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে সামান্য পার্থক্য রয়েছে:
- মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (MI) হলো একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক শব্দ, যা বোঝায় হৃদপিণ্ডের পেশীর (myocardium) কোষে অক্সিজেনের অভাবে স্থায়ী ক্ষয় বা মৃত্যু ঘটে গেছে। এখানে “ইনফার্কশন” মানে কোনো টিস্যুর মৃত্যু, যা রক্ত সরবরাহের অভাবে হয়।
- হার্ট অ্যাটাক একটি সাধারণ, অ-চিকিৎসাবিদ শব্দ, যা মানুষ দৈনন্দিন ভাষায় ব্যবহার করে যখন হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহে সমস্যা হয় এবং বুকের তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হার্ট অ্যাটাক মানে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বোঝানো হয়, তবে এটি কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক রক্তপ্রবাহের সমস্যা (যেমন অ্যাঞ্জাইনা) বা অন্যান্য হৃদযন্ত্রের ত্রুটিও নির্দেশ করতে পারে।
সংক্ষেপে বলা যায়-
- মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলো হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা।
- হার্ট অ্যাটাক বলতে সাধারণত মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনকেই বোঝানো হয়, তবে শব্দটি একটু বেশি সাধারণ এবং কিছুটা বিস্তৃত অর্থ বহন করতে পারে।
কেন ঘটে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন?
রক্তনালী ব্লক হওয়া- মূল কারণ
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো হৃদপিণ্ডের ধমনীতে রক্তপ্রবাহের বাধা সৃষ্টি হওয়া। সাধারণত করোনারি ধমনীতে চর্বি, কোলেস্টেরল ও অন্যান্য আবর্জনাসদৃশ পদার্থ জমে ধমনীর ভেতরে প্লাক তৈরি হয়, যাকে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস বলে। যখন এই প্লাক ফেটে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সেখানে রক্ত জমাট বাঁধে এবং সেই জমাট ধমনীকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে। ফলস্বরূপ, হৃদপিণ্ডের কোনো নির্দিষ্ট অংশে অক্সিজেন এবং পুষ্টির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ওই পেশী কোষগুলো মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয় বা মারা যায়। যদি এই ব্লকেজ দ্রুত খুলে না দেওয়া হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়তে থাকে এবং জীবন-হুমকিস্বরূপ জটিলতা সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে করোনারি ধমনীর স্বতঃস্ফূর্ত সংকোচন (coronary artery spasm) বা রক্তনালীর অস্বাভাবিক সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কারণেও রক্তপ্রবাহ বন্ধ হতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। এই সংকোচন সাধারণত ধূমপান, ড্রাগ (যেমন কোকেইন) সেবন বা তীব্র মানসিক চাপের কারণে হতে পারে। তবে, প্লাক-সংক্রান্ত ব্লকেজ সবচেয়ে বেশি সাধারণ এবং সর্বাধিক ঘটনার জন্য দায়ী। এ কারণে হৃদরোগ প্রতিরোধে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ বজায় রাখা এবং ধমনী সুস্থ রাখার গুরুত্ব অপরিসীম।
ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাত্রার ভূমিকা
আধুনিক জীবনের অসচেতন অভ্যাসগুলো মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উচ্চমাত্রার ফাস্ট ফুড খাওয়া, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (যেমন অতিরিক্ত চর্বি ও লবণযুক্ত খাবার), নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব এবং দীর্ঘসময় বসে থাকা – সবকিছু মিলে হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। শরীরে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পেলে তা উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার জন্ম দেয়, যা প্রত্যক্ষভাবে করোনারি ধমনী ব্লক করার ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান রক্তনালীর দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং রক্তে অক্সিজেন পরিবহণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা আরো ত্বরান্বিত করে।
মাঝেমধ্যে আমরা মানসিক চাপকেও অবহেলা করি, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস বা উদ্বেগ সরাসরি হৃদরোগের সাথে যুক্ত। মানসিক চাপে শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা হৃদস্পন্দন বাড়ায় এবং রক্তচাপও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে। এর ফলে হৃদপিণ্ডের উপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং করোনারি ধমনীগুলো সংকুচিত হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন – যেমন পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন – সব মিলিয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। তাই সুস্থ হৃদয়ের জন্য সচেতন জীবনযাত্রার অবলম্বন অপরিহার্য।
পারিবারিক ইতিহাস ও বংশগত প্রভাব
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের ঝুঁকি অনেকাংশে বংশগত কারণেও নির্ভর করে। যদি কোনো ব্যক্তির পরিবারে (বিশেষ করে বাবা-মা বা সহোদর) আগে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে, তাহলে তার নিজেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এটি বোঝায় যে তাদের দেহের গঠন, বিপাক ক্রিয়া (metabolism) বা রক্তে চর্বির মাত্রার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য জেনেটিক্যালি প্রভাবিত। কিছু নির্দিষ্ট জিন (genes) ধমনীতে প্লাক তৈরির প্রবণতা বা উচ্চ রক্তচাপের ঝোঁক তৈরি করতে পারে। ফলে, এক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ঝুঁকিপূর্ণ জীবনধারা পালন করে, তবে তার হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বহুগুণ বেড়ে যায়।

বংশগত প্রভাব থাকলেও সচেতনতার মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। পারিবারিক ইতিহাস জানা থাকলে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা, জীবনধারার সংশোধন ও সময়মতো চিকিত্সকের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে সেগুলোর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ হৃদরোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ধূমপান পরিহার, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে বংশগত ঝুঁকিও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। অর্থাৎ, জেনেটিক ঝুঁকি থাকলেও সচেতনতা ও সঠিক জীবনচর্চা দ্বারা হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখা সম্ভব।
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এর পূর্বলক্ষণ
বুকে চাপ বা ব্যথা
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সবচেয়ে সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক সংকেত হলো বুকের মাঝখানে চাপ বা ব্যথা অনুভব করা। এই ব্যথা সাধারণত একটানা কয়েক মিনিট স্থায়ী হয় অথবা কমে গিয়ে আবার ফিরে আসে। ব্যথাটি বেশিরভাগ সময় বুকের মাঝখানে একটি ভারী বোঝার মতো চাপ অনুভূত হয়, কেউ যেন বুক চেপে ধরছে বা পাথর চাপা পড়েছে এমন অনুভূতি হতে পারে। কখনো কখনো এই ব্যথা হাত, ঘাড়, চোয়াল, পিঠ বা এমনকি পেটের ওপরের অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি হার্টের পেশীতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছানোর সরাসরি ফলাফল।
তবে মনে রাখা দরকার, সবসময় এই ব্যথা তীব্র হতে নাও পারে। বিশেষ করে মহিলাদের, বৃদ্ধদের এবং ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ব্যথা তুলনামূলক মৃদু বা অস্বাভাবিক ধরনের হতে পারে। অনেক সময় এটি শুধু সামান্য অস্বস্তি, চাপ বা জ্বলুনির মতো অনুভূত হয়, যা উপেক্ষা করা সহজ। তাই বুকের যেকোনো অস্বাভাবিক অনুভূতিতে সতর্ক হওয়া জরুরি এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়।
শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত ঘাম
শ্বাসকষ্ট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বলক্ষণ। যখন হৃদপিণ্ড যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়, তখন ফুসফুসে তরল জমে যেতে পারে, ফলে রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে সামান্য পরিশ্রমেও যদি হঠাৎ শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, তাহলে এটি হৃদযন্ত্রের জটিলতার ইঙ্গিত দিতে পারে। কখনো কখনো রোগী বিশ্রাম অবস্থাতেও শ্বাসকষ্টে ভোগেন, যা আরো গুরুতর সংকেত। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে যদি বুকের চাপ বা ব্যথা যুক্ত থাকে, তাহলে দ্রুত জরুরি চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অতিরিক্ত ঘাম – বিশেষ করে ঠান্ডা ঘাম – মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের আরেকটি সতর্কবার্তা। হৃদপিণ্ড যখন ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে পারে না, তখন শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘাম দিয়ে অতিরিক্ত চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। রোগীরা প্রায়ই বলেন যে তারা ব্যায়াম না করেও যেন প্রচণ্ড পরিশ্রমের মতো ঘেমে যাচ্ছেন। ঠান্ডা ঘাম সাধারণত হঠাৎ করেই শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘাম কোনো সাধারণ গরম বা আবহাওাজনিত নয়; এটি হার্টে বিপদের ইঙ্গিত দেয়।
অবসাদ ও দুর্বলতা: অপ্রচলিত লক্ষণ
অনেক সময় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের পূর্বে অস্বাভাবিক অবসাদ (Fatigue) বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে। রোগীরা অনুভব করতে পারেন যে, তারা দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম, যেমন হাঁটা, কাপড় পরিবর্তন বা রান্নার মতো সাধারণ কাজেও অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। এটি মূলত হৃদপিণ্ডে পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহের অভাবের কারণে হয়, যার ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো অক্সিজেনের সংকটে ভোগে। এই অবসাদ হয় দীর্ঘমেয়াদী এবং বিশ্রাম নিলেও তা সহজে দূর হয় না।
অল্প পরিশ্রমে বা কোনো কারণ ছাড়াই দুর্বল অনুভব করাও মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের একটি অপ্রচলিত লক্ষণ। কখনো কখনো রোগীরা হাঁটাহাঁটি, সিঁড়ি ভাঙা বা হালকা কাজের পরই হঠাৎ প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভব করেন। এটি বিশেষ করে ডায়াবেটিস আক্রান্ত, বৃদ্ধ এবং মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, যেখানে ক্লাসিকাল বুক ব্যথার পরিবর্তে দুর্বলতা ও অবসাদই প্রধান লক্ষণ হিসেবে উপস্থিত হয়। তাই হঠাৎ অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা দুর্বলতার অনুভূতিকে হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়; বরং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হলে তাৎক্ষণিক করণীয়
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের লক্ষণ দেখা দিলে প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো অবিলম্বে সচেতন থাকা এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো। বুকের মাঝখানে তীব্র চাপ, ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হলে অথবা সেই ব্যথা হাত, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠে ছড়িয়ে পড়লে, রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া বন্ধ করে বিশ্রামে রাখতে হবে। রোগীকে আরামদায়ক অবস্থানে বসানো বা শুয়ে রাখা উচিত এবং যদি সম্ভব হয় তাহলে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি চিকিৎসাসেবা (Emergency Medical Service) ডাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই রোগীকে নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করা উচিত নয়; কারণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
রোগী যদি সচেতন থাকে এবং বড় কোনো অ্যালার্জি না থাকে, তাহলে দ্রুত একটি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট চিবিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে (সাধারণত 300 মি.গ্রা. ডোজের)। অ্যাসপিরিন রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে এবং ধমনীতে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। এ ছাড়া, যদি রোগী পূর্ব থেকে নিযুক্ত নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করে থাকেন, তবে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী তা ব্যবহার করানো যেতে পারে। দ্রুত এবং সঠিক প্রতিক্রিয়া হার্টের ক্ষতি কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জরুরি চিকিৎসা নেওয়ার প্রথম ধাপ
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সময় জরুরি চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো – রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন এবং তারপরে দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া। যখন হার্ট অ্যাটাকের সন্দেহ হয়, তখন রোগীর রক্তচাপ, পালস রেট এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করা দরকার। জরুরি সেবাকর্মীরা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG) করে দেখতে পারেন যে হৃদপিণ্ডে রক্তপ্রবাহের কোনো ব্যাঘাত ঘটেছে কিনা। রক্তে টপোনিন নামক প্রোটিনের মাত্রা নির্ণয় করাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি হার্টের ক্ষতির স্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করে।
একবার হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত হলে, দ্রুত রক্তপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি (রক্তের জমাট গলানোর ইনজেকশন) বা জরুরি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতে ব্লক হওয়া ধমনীর ভেতর স্টেন্ট বসিয়ে রক্তপ্রবাহ পুনরায় চালু করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারিও দরকার হতে পারে। সময়ই এখানে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর – যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়, তত বেশি হার্ট টিস্যু বাঁচানো সম্ভব। এজন্য প্রতিটি মিনিটই মূল্যবান।
CPR ও প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্ব
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সময় যদি রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়, শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বা পালস অনুভূত না হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে CPR (Cardiopulmonary Resuscitation) শুরু করা জরুরি। CPR-এ বুকের ওপর বারবার চাপ (compressions) এবং মুখ দিয়ে শ্বাস দেওয়া (rescue breaths) করে হৃদপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে সাময়িকভাবে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখা হয়। যদি দ্রুত CPR শুরু করা যায়, তাহলে হৃদপিণ্ড পুনরায় সচল হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর আশেপাশে উপস্থিত ব্যক্তিরা যদি দ্রুত সঠিকভাবে CPR দিতে পারে, তাহলে হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই জীবন রক্ষা সম্ভব হয়। তাই সাধারণ মানুষকেও CPR শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু জায়গায় পাবলিক স্থানে Automated External Defibrillator (AED) মেশিন থাকে, যা দিয়ে হার্টের অস্বাভাবিক স্পন্দন (Arrhythmia) ঠিক করা যায়। তাই CPR এবং প্রাথমিক চিকিৎসার শিক্ষা শুধু ডাক্তার বা নার্সদের জন্য নয়, বরং প্রত্যেক সচেতন মানুষের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবনরক্ষাকারী দক্ষতা।
উপসংহার
মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো ভয়ানক একটি অবস্থা, তবে সচেতনতা ও সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে এ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান বর্জন এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ- এই চারটি অভ্যাস পারে আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে। মনে রাখুন, হার্ট একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন, কিন্তু সতর্ক হলে হার্টের সুস্থতা বজায় রাখা পুরোপুরি সম্ভব। তাই আজই নিজের ও প্রিয়জনের জন্য হার্টের যত্ন নিন এবং সুস্থ জীবন গড়ুন।